|
|
|
|
|
ফের মাওবাদী
আনাগোনায় সিঁদুরে মেঘ সুরবেক বিশ্বাস • কলকাতা |
|
• চিকিৎসা করাতে সম্প্রতি বারিকুলে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় সারির মাওবাদী নেতা বিকাশ।
• মাওবাদীদের রাজ্য মিলিটারি কমিশনের সদস্য রঞ্জিত পাল পুরুলিয়ার বলরামপুর ও বাঘমুণ্ডিতে গিয়েছিলেন ‘নিজেদের লোকের’ সঙ্গে দেখা করতে।
• সোমবার রাতে পার্টির লিঙ্কম্যানদের চাঙ্গা করতে ঝাড়গ্রামের বাঁকিশোল ও চণ্ডীপুরে ঢুকেছিলেন মাওবাদী অ্যাকশন স্কোয়াডের নেতা জয়ন্ত ওরফে সাহেবরাম হেমব্রম।
• ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলা থেকে বেলপাহাড়িতে ঘনঘন ঢুকছেন মদন মাহাতো এবং তাঁর দল। তাঁরা খাবারদাবারও পাচ্ছেন গ্রাম থেকে।
গোয়েন্দাদের এই সব খবরই বলে দিচ্ছে, কোণঠাসা হয়ে পড়লেও মাওবাদী নেতাদের আনাগোনা বন্ধ হয়নি। পঞ্চায়েত ভোটে জঙ্গলমহল জুড়ে শাসক দলের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও ওই তল্লাটে তাঁদের যাতায়াত চলছেই।
এই অবস্থায় ৫ অক্টোবর, শনিবার মাওবাদীদের ডাকা ভারত বন্ধে জঙ্গলমহলে কোথায় কতটা প্রভাব পড়ে, সে-দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন গোয়েন্দারা। গত ১৪ সেপ্টেম্বর মালকানগিরিতে পুলিশের হাতে এক মহিলা-সহ ১৩ জন মাওবাদীর নিহত হন। তারই প্রতিবাদে বন্ধের ডাক দিয়েছে মাওবাদীরা। বন্ধ নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেস বিবৃতিতে পার্টির মুখপাত্র অভয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রমন সিংহ, নবীন পট্টনায়ক, কিরণ রেড্ডি ও শিবরাজ সিংহ চহ্বাণের মতো অন্যান্য মাওবাদী-প্রভাবিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে ফেলেছেন। বলেছেন, ওঁদের প্রত্যেকেই মনে করেন, ওঁরা সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো ছিনিমিনি খেলতে পারেন।
মাওবাদীদের ডাকা বন্ধের সমর্থনে কোথাও পোস্টার দেওয়া বা দেওয়াল-লিখন হয় কি না, সে-দিকে নজর রাখার জন্য জঙ্গলমহলের পুলিশ ও যৌথ বাহিনীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড়, গোয়ালতোড়, শালবনি, কোতোয়ালি; ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার বেলপাহাড়ি, বিনপুর, জামবনি, ঝাড়গ্রাম, গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রাম; পুরুলিয়ার বলরামপুর, বাঘমুণ্ডি, বান্দোয়ান এবং বাঁকুড়ার সারেঙ্গা, রাইপুর, বারিকুল ও বান্দোয়ান মূলত এই সব এলাকায় বিশেষ নজরদারি শুরু হয়েছে গোয়েন্দাদের।
নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা সত্ত্বেও দ্বিতীয় সারির বেশ কয়েক জন মাওবাদী নেতা যে বেমালুম ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেটাই পুলিশ ও গোয়েন্দাদের উদ্বেগের সব চেয়ে বড় কারণ। শীর্ষ নেতা কিষেণজি নিহত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। এত দিনেও বিকাশ, আকাশ ও মাধাই পাত্রের মতো মাওবাদীদের রাজ্য স্তরের নেতা এবং জয়ন্ত, মদন মাহাতো, শ্যামল, তারার মতো স্থানীয় নেতানেত্রীদের গ্রেফতার করতে না-পারাটা গোয়েন্দাদের গলায় কাঁটার মতো বিঁধছে। সম্প্রতি ছত্তীসগঢ়ের গহন অরণ্যে মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে গৃহীত ১১ পাতার প্রস্তাবে আগামী দু’বছরের পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে পার্টির দ্বিতীয় সারির নেতৃত্বকে তুলে
আনার কথা বলা হয়েছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গে কিষেণজির হাতে তৈরি এই দ্বিতীয় সারির জঙ্গি নেতারাই এখনও অধরা।
রাজ্যের কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্স (সিআইএফ)-এর এক কর্তা বলেন, “সম্প্রতি মাওবাদী নেতা বিকাশ ঝাড়খণ্ড থেকে বাঁকুড়ার বারিকুলে এসেছিল। আমরা জেনেছি, বিকাশের হাতে গুরুতর সমস্যা হয়েছে। সে চিকিৎসা করাতেই এসেছিল।” ওই কর্তার মন্তব্য, দেখা যাচ্ছে, বিকাশের জন্য চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে দেওয়ার লোক এই পরিস্থিতিতেও জঙ্গলমহলে রয়েছে। এটাই সব চেয়ে চিন্তার বিষয়।
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ অফিসার পরিষ্কার জানাচ্ছেন, জঙ্গলমহলে শাসক দল বিপুল ভাবে জিতে গিয়েছে বলেই এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, মাওবাদীদের জনসমর্থন একেবারে শেষ। তিনি বলেন, “মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করেন, এমন বহু মানুষ এখনও ওই তল্লাটে রয়েছেন।” তাঁর বক্তব্য, মাওবাদী লিঙ্কম্যানেরা চুপচাপ আছে ঠিকই। কিন্তু তাদের চাঙ্গা করার জন্য মাওবাদী নেতারা মাঝেমধ্যেই যাতায়াত করছেন। সোমবার রাতেও জয়ন্ত ওরফে সাহেবরাম হেমব্রম ঝাড়গ্রামের বাঁকিশোল ও চণ্ডীপুরে গিয়েছিলেন। ওই পুলিশকর্তার মন্তব্য, “বর্তমান পরিস্থিতিতেও মাওবাদীরা জঙ্গলমহলের গ্রামে ঢুকে রাত কাটানোর সাহস কোথা থেকে পাচ্ছে, সেটাই খুঁটিয়ে দেখতে হবে।”
মাওবাদীদের দ্বিতীয় স্তরের নেতারা যে এ ভাবে আনাগোনা করছেন, সেই তাগিদের উৎস কী?
মোক্ষম ধাক্কা খাওয়াটাই সেই উৎস বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবে পার্টির ‘লালগড় তথা পশ্চিমবঙ্গ আন্দোলন’-এর ধাক্কা খাওয়ার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। মাওবাদীদের শীর্ষ নেতৃত্ব মানছেন, দেশ জুড়েই পার্টি সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং কিষেণজির মতো নেতার নিহত হওয়া ও পার্টির নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে পার্টিকে দুর্বল করে দিয়েছে। আর এই ঘা খাওয়া অবস্থা থেকেই মাওবাদীরা ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।
বসে নেই নিরাপত্তা বাহিনীও। সিআইডি-র এডিজি শিবাজী ঘোষ বলেন, “মাওবাদীদের নিয়ে ঢিলেঢালা মনোভাব দেখানোর কোনও সুযোগই নেই। রাজ্যে এই মুহূর্তে মাওবাদী কার্যকলাপ না-থাকলেও আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে সমস্যা রয়েছে। সেখান থেকে বাংলায় ঢুকে পড়ে নাশকতা চালাতে কত ক্ষণ?”
অতএব দ্বিতীয় সারির মাওবাদী নেতারা যেমন আনাগোনা চালিয়ে যাচ্ছেন, পাল্লা দিয়ে প্রস্তুতি আর নজরদারি চালাচ্ছেন গোয়েন্দারাও। |
|
|
|
|
|