আয় বেড়েছে অনেকটাই। কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খরচের বহরও। তাই কর্মচারীদের বেতন দিতে ফি-মাসে ধার করতে হচ্ছে অর্থ দফতরকে। এমন পরিস্থিতিতে রাজ্যের আর্থিক অবস্থা যাচাই করে ২০ দফা পরামর্শ দিয়েছে কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। যার মোদ্দা কথা হল, দীর্ঘদিন ধরে রাজকোষ পরিচালনায় যে বিশৃঙ্খলা চলছে, তা কাটিয়েই আর্থিক হাল ফেরানোর পথ খুঁজে পেতে পারে রাজ্য। সিএজি-র পরামর্শ মেনে আর্থিক ক্ষেত্রে সংস্কারের পথে নামতে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। ঢেলে সাজা হচ্ছে সরকারের জমা-খরচের খাতা।
সিএজি-র এক মুখপাত্রের কথায়, “গত দু’বছরে রাজ্যের নিজস্ব আয় অনেকটাই বেড়েছে। কিন্তু খরচও বেড়েছে লাগামছাড়া। যার সিংহভাগ যাচ্ছে নানা ধরনের অনুদান দিতে। কন্যাশ্রী থেকে যুবশ্রী, কৃষকরত্ন থেকে বিডিও রত্ন, খেল সম্মান থেকে উত্তম পুরস্কার, বঙ্গভূষণ, বঙ্গবিভূষণ থেকে ইমাম-মোয়াজ্জিন ভাতার মতো নানাবিধ কার্যক্রম নিয়েছে রাজ্য। ফলে আয় বাড়লেও খরচের চাপে বাড়ছে ঋণের বহর।” ওই কর্তার বক্তব্য, “এর মধ্যেও আর্থিক পরিস্থিতি কিছুটা ভাল হতে পারত, যদি অর্থ দফতর খরচে লাগাম টানতে পারত। তা না-হওয়ার ফলেই বহু কোটি টাকা গলে যাচ্ছে, কিন্তু হিসেব মিলছে না। সেই মর্মেই বিশ দফা পরামর্শ দিয়ে রাজকোষের স্বচ্ছতা ফেরাতে বলা হয়েছে।”
প্রতি বছরই বাজেট পেশের পরে রাজ্যের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে মতামত দেয় সিএজি। কিন্তু এ বারেই প্রথম তারা প্রথম পরামর্শ দিল বলে জানিয়েছেন অর্থ দফতরের কর্তারা। পরামর্শ দিতে গিয়ে দফতরের কর্তাদের সামনে রীতিমতো পাওয়ার-পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন (পোশাকি নাম এন্ট্রি কনফারেন্স) দিয়েছে সিএজি। তাতে মূলত খরচের অস্বচ্ছতার দিকগুলি দেখিয়ে সংস্কার করতে বলা হয়েছে। আর সেটা করলে কী ভাবে বাড়তি টাকা জোগাড়ের পথ খুলবে, তা-ও দেখিয়ে দিয়েছে তারা। যেমন
• রাজ্য বাজেটে ‘অন্যান্য খরচ’ নামে একটি খাত রয়েছে। নিয়ম হল, যে হেতু এই খাতে খরচের কোনও নির্দিষ্ট বিবরণ থাকে না, সে হেতু অত্যন্ত সতর্ক হয়ে খরচ করতে হবে। কিন্তু ২০১৩-’১৪ আর্থিক বছরে এই খাতে ৬২৩১ কোটি টাকা খরচ হবে বলে দেখিয়েছে অর্থ দফতর, যা মোট বাজেট বরাদ্দের ৬.১১%। ২০১২-’১৩ সালে ওই খাতে খরচ হয়েছে ৫০১৮ কোটি। সিএজি-র পরামর্শ, এ ভাবে ‘অন্যান্য খরচ’ খাতে বিপুল বরাদ্দ মোটেই স্বচ্ছতার লক্ষণ নয়। এই খাতে খরচ প্রায় বন্ধ করে দিলে ৬ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত সাশ্রয় হতে পারে। যা কাজে লাগানো যেতে পারে নির্দিষ্ট প্রকল্পে।
• সিএজি জানিয়েছে, সরকারি প্রকল্পের টাকা বিভিন্ন ‘ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট’ (পার্সোনাল ডিপোজিট অ্যাকাউন্টস) জমা রাখার প্রবণতা মারাত্মক বেড়েছে। শুধু তাই নয়, যাঁর অ্যাকাউন্টে সরকারি টাকা রয়েছে, তিনি ছাড়া অন্য ব্যক্তিও সেই টাকা খরচ করছেন। যেমন, নন্দনের সিইও-র ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা খরচ করছেন নন্দনের অ্যাকাউন্টস অফিসার। ২০১১-’১২ অর্থবর্ষে এই ধরনের একাধিক অ্যাকাউন্টে মোট ২৩৮৪ কোটি টাকা রাখা হয়েছিল। এই ধরনের অ্যাকাউন্ট যতটা সম্ভব কমিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছে সিএজি। তাদের প্রশ্ন, সরকারি প্রকল্পের টাকা কেন ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে রাখতে হবে।
• বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে রাজ্যগুলিকে অনুদান দেয় কেন্দ্র। নিয়ম অনুযায়ী, অনুদানের টাকা খরচ করার পর তার হিসেব পেশ করতে হয়। সিএজি জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় অনুদানের ৪৯ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার কোনও হিসেব দেয়নি অর্থ দফতর। এই ঘটনা রাজ্যের আর্থিক বিশৃঙ্খলার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। অবিলম্বে কেন্দ্রীয় অনুদানের ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ পেশ করতে বলেছে সিএজি। তাদের বক্তব্য: এই হিসেব পাওয়া গেলে বোঝা যাবে কতটা খরচ হয়েছে। যদি দেখা যায়, এখনও মোটা টাকা খরচ হয়নি, তা হলে সরকার সেটা কাজে লাগাতে পারে। পাশাপাশি, ১৯৯৪-’৯৫ সাল থেকে ২০১৩-এর মার্চ পর্যন্ত ৮২০ কোটি টাকা অগ্রিম নিয়েছে বিভিন্ন দফতর। এর মধ্যে অন্তত ২৫০-৩০০ কোটি টাকার হিসেব গত পনেরো বছর ধরে দেওয়া হয়নি। হিসেব দাখিলে কড়া মনোভাব দেখালে তুচ্ছ কারণে অগ্রিম নেওয়ার প্রবণতাও কমবে বলে মনে করে সিএজি।
• চলতি অর্থ বছরের বাজেটে ৯১টি নতুন ‘হেড অব অ্যাকাউন্টস’ খুলে ২০১৫ কোটি টাকা খরচের কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য। সিএজি বলছে, তারা এর বিন্দুবিসর্গ জানে না। তাদের কোনও অনুমোদনই নেওয়া হয়নি। অর্থ দফতর অনুমোদন নিতে এলে গোড়াতেই বলে দেওয়া যেত, কোন খরচ আইনি আর কোনটা বেআইনি।
বেআইনি খরচ শুরু করে তা বন্ধ করে দেওয়ার বদলে আগে থেকে পরামর্শ করে নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে সিএজি।
আরও আছে। বিভিন্ন দফতরে যেমন টাকা খরচ হয়, তেমনই রাজস্ব আদায় হয়। দফতরের কন্ট্রোলিং অফিসারদের খাতায়-কলমে জমা-খরচের হিসেবের সঙ্গে বাস্তবে তা নিয়মিত মিলিয়ে দেখার কথা। একে বলা হয় ‘রিকনসিলিয়েশন অব অ্যাকাউন্টস’। বার বার বলা সত্ত্বেও ২০১১-’১২ সালে বিভিন্ন দফতরে যে পরিমাণ টাকা জমা হয়েছে তার ৫৭.০৯% এবং যে টাকা খরচ হয়েছে তার ৩৮.২০% মিলিয়ে দেখা হয়েছে। সিএজি-র পরামর্শ, খাতায় কলমে কত আয়-ব্যয় হল, আর বাস্তবে ঠিক কত জমা-খরচ হল, তা মেলালেই বিস্তর ফারাক ধরা পড়বে। আর্থিক অনিয়ম গোড়ায় বিনাশ করতে নিয়মিত হিসেবের খাতার ‘রিকনসিলিয়েশন’ প্রয়োজন বলে জানিয়েছে সিএজি। এ রকম আরও কয়েক দফা পরামর্শ এখন শিরোধার্য করেছে অর্থ দফতর।
দফতরের এক কর্তার কথায়, “সিএজি যে বিষয়গুলি চিহ্নিত করেছে, তা বাম জমানা থেকেই চলে আসছে। এখন সেগুলির আমূল সংস্কার করা হবে।” আর এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের বরাবরের বক্তব্য হল: বাম জমানার রীতিনীতি বদলে আরও স্বচ্ছতা এবং সংস্কার আনার পাশাপাশি অর্থ দফতরের বিকেন্দ্রীকরণও করা হয়েছে। দফতরগুলিকে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তার সুফলও ফলতে শুরু করেছে।
|