পুরনো জামাকাপড় থেকে শুরু করে ওষুধপত্র, গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে চাল-ডাল, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র থেকে শুরু করে মাদক এমনকী গরু-মানুষ পাচার দেখে দেখে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের চোখ পচে গিয়েছে। পুলিশ-বিএসএফ যতই কড়া তল্লাশি চালাক আর নজরদারির দাবি করুক, বনগাঁ সীমান্তে পাচার বন্ধ হয়নি। তবে গত কয়েক মাসে পাচারের তালিকায় নতুন ‘আইটেম’ ঢুকে পড়ায় বিস্মিত সকলেই। সারি সারি মহিষও যে সীমান্তের এ পার থেকে বাংলাদেশে পাচার হতে পারে, তা জানতে পেরে মাথায় হাত পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের।
মূল রাতের অন্ধকারেই চলছে মহিষ পাচার। কিন্তু কেন বাংলাদেশে হঠাত্ জনপ্রিয় হয়ে উঠল মহিষ? বিএসএফ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি সূত্র জানাচ্ছে, মহিষের মাংস অল্প দামে বিক্রি হয় বাংলাদেশের বাজারে। কিলো প্রতি ১৩০-১৪০ টাকা। সব মিলিয়ে একটি মহিষের দাম বাংলাদেশে পড়ে প্রায় ২০০০০ টাকা। আর সেটাই এ পার বাংলা থেকে ও পার বাংলায় মহিষ পাচারের কারণ হয়ে উঠেছে। মূলত উত্তরপ্রদেশ, বিহার, হরিয়ানা থেকে ট্রাকে চাপিয়ে ধুমসো কালো মহিষের পাল আনা হচ্ছে বনগাঁ মহকুমার তেঁতুলবেড়িয়া, বড় সেহানা, ছোট সেহেনা, বাগানগ্রাম, সুটিয়া প্রভৃতি গ্রামে। পরে রাতের অন্ধকারে সে সব পাচার হয়ে যাচ্ছে সীমান্তের ও পারে।
গরু পাচারের তুলনায় মহিষ পাচার তুলনায় সহজ বলে জানালেন স্থানীয় কিছু মানুষ। কারণ কালো কালো চেহারার মহিষ অন্ধকারে নজর এড়িয়ে যায় বিএসএফেরও। তা ছাড়া, মহিষ শারীরিক ভাবে গরুর থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে তুলনায় কম। অল্প খাদ্যে বেশি দিন থাকতে পারে তারা। সব মিলিয়ে পাচারকারীদের পক্ষেও মহিষ তুলনায় বেশি লাভের। প্রতিটি মহিষের গায়ে রং দিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যা লেখা থাকে। বাংলাদেশে হাত বদলের পরে ওই সংখ্যা দিয়েই চিনে নেওয়া হয় তাদের।
গরু পাচার সীমান্তবর্তী এই গ্রামগুলিতে দীর্ঘ দিনের সমস্যা। একে তো বাংলাদেশি পাচারকারীদের দাপটে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা বাড়ে। তার উপরে, ফসলের খেত মাড়িয়ে গরু নিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। গ্রামের মানুষের ক্রমান্বয়ে পুঞ্জীভূত অসন্তোষের চাপে ফসলের খেত নষ্ট করে গরু পাচার ইদানীং কিছুটা কমেছে বলে জানালেন স্থানীয় মানুষ। নির্দিষ্ট ‘করিডর’ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গরু। যদিও বিএসএফ এবং পুলিশের দাবি, নিয়মিত নজরদারি, ধরপাকড়ের ফলে গরু পাচার অনেকটাই কমেছে। তবে ইদানীং বাড়ছে মহিষ পাচার।
মাস ছ’য়েক আগে বনগাঁ মহকুমা দিয়ে মহিষ পাচারের ঘটনা প্রথম নজরে পড়ে পুলিশের। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত শ’খানেক পাচারের মহিষ ধরেছে পুলিশ-বিএসএফ। এক পুলিশ কর্তা জানালেন, প্রথম দিকটায় সারি দিয়ে মহিষ নিয়ে যেতে দেখলেও সন্দেহ হত না কারও। জিজ্ঞাসা করলে উত্তর মিলত, পোষার জন্য আনা হয়েছে। পরে বোঝা গেল আসল কাণ্ডটা। গরুর পালের মধ্যে দু’একখানা মহিষ ছেড়ে রাখা দিয়ে শুরু হয়েছিল মহিষ পাচার। তারপর আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল পাচার হওয়া মহিষের সংখ্যা।
বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক বিশ্বজিত্ দাস বলেন, “শুধু গরু-মহিষ নয়, সব ধরনের পাচার বন্ধের জন্যই পুলিশ-বিএসএফকে বার বার বলা হয়েছে।” বনগাঁর এসডিপিও রূপান্তর সেনগুপ্তের কথায়, “গরু-মহিষ পাচারের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। অনেক গরু-মহিষ আটক করাও হচ্ছে।”
পুলিশ-প্রশাসন যা-ই বলুক, স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, মাঝে মধ্যে কম হলেও পাচার পাকাপাকি বন্ধ হতে দেখা এই এলাকার মানুষের ভাগ্যে নেই। এলাকার অর্থনীতির একটা বড় ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে পাচারের কালো টাকা। পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ তো বটেই, রাজনৈতিক দলের কাছেও পৌঁছয় সেই বখরা, এমনটাই অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। যথারীতি সেই অভিযোগ মানেনি কোনও পক্ষই।
বনগাঁ শহরের এক বাসিন্দাকে হাল্কা চালে বলতে শোনা গেল, “এ বছর পুজোর আগেই প্রথম মহিষ পাচারের ব্যাপারটা জানাজানি হল। মনে হয় মহিষাসুরমর্দিনী নিজেও কৈলাস থেকে মর্ত্যে এসে এ সব দেখেশুনে ভিরমি খেয়ে যাবেন!” |