পুজোয় যখন কাজের জায়গা থেকে ছুটি নিয়ে ঘরে ফেরেন মানুষ, তখনই ঘর ছাড়তে হয় ওঁদের, ঢাক বাজানোর দায়ে। বায়নার দিন থেকে বিসর্জনের দিন পর্যন্ত কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপে ঢাক বাজান ওঁরা। এই ক’দিনে সাকুল্যে রোজগার হয় ৪ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা। কিন্তু সেই রোজগারের আশায় গুরুর বাড়িতে জোরদার মহড়া দিচ্ছেন ঢাকিরা।
উত্তর ২৪ পরগনার হাবরা বা নদীয়ার শান্তিপুর থেকে আসা ঢাকিরা সকলেই জড়ো হয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনা ও নদিয়ার সীমানায়, উত্তর ব্রহ্মপুরে নিমতলায় গুরু প্রিয়লাল দাসের বাড়ি।
সেখানে মহড়ার পরে তাঁরা যাবেন শিয়ালদহে। কয়েকদিন ধরে পুজো উদ্যোক্তাদের সামনে চলবে ঢাক বাজানো। প্রমাণ দেবেন নিজেদের যোগ্যতার। তার পর বায়না মিলবে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়বেন বিভিন্ন মণ্ডপে।
ঢাকিরা জানাচ্ছেন, পেটের দায়ে অন্য ভাবেও রোজগারের চেষ্টা করতে হয় সারা বছর। বাজনার অনুশীলনও ঠিক মতো হয় না। তাই পুজোর আগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলে অভিজ্ঞ ঢাকির বাড়িতে। দেখা হয় গুরু বা সতীর্থদের সঙ্গে। |
শান্তিপুর থেকে নিমতলায় এসেছেন ঢাকি সুবোধচন্দ্র দাস। বলেন, “অন্য সময়ে ছোটখাটো পুজোতে ঢাক বাজানোর ডাক পড়ে। ঢাক ঢোল মেরামত করেও সামান্য রোজগার হয়। তবে তাতে আর কীই বা হয়? ছেলেমেয়েরাও এই পেশায় আসতে চায় না। আমাদের তো কেউ শিল্পী বলেই মনে করে না।” গুরু প্রিয়লালবাবুকেও হতাশ শোনায়। বলেন, “কি জানি, এ বার হয়তো পেশাটাই লুপ্ত হয়ে যাবে!”
সারা বছর ঢাক বাজালেও বড় রোজগারটুকু পুজোর সময়েই হয়। কিন্তু মজুরি এত কম যে চলে না তাতে। এর সঙ্গে রয়েছে অসম্মান, অবজ্ঞা। পুজো উদ্যোক্তাদের দুর্ব্যবহার। তাই এই পেশা ও এই পেশার মানুষকে বাঁচাতে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছেন ওঁরা। হাবরায় গড়ে উঠেছে ‘বাংলার সৌহার্দ্য’ নামে ঢাকি ও বাউল শিল্পীদের সংগঠন। বছর ছয়েকের এই সংগঠনে আনতে পেরেছেন ২৫০ জন ঢাকিকে।
সংগঠনের সম্পাদক সঞ্জীব সরকার বলেন, “ঢাকের বাজনার কদর ক্রমশ কমছে। কেবলমাত্র পুজোর অনুসঙ্গ হিসেবে ঢাক টিকে রয়েছে। ঢাকিরা তো প্রাপ্য মর্যাদাও পান না। অথচ গানের সঙ্গত হিসেবেও তো ঢাক ব্যবহার করা যায়! আমরা ঢাকের বাজনার প্রসার চাই। তাই ঢাকিদের এক ছাতার তলায় আনতে চাইছি। রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গান বাজনার কোর্স থাকলেও ঢাকের জন্য কিছুই নেই। আমরা বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেছি।”
ঢাকি বিশ্বজিৎ দাস, শ্যামজিৎ বিশ্বাস, অভিজিৎ দাসেরা জানালেন, দিন দিন ঢাক তৈরির উপকরণের দাম যে ভাবে বাড়ছে, তাতে বাজনা বাজিয়ে পড়তায় পোষাচ্ছে না। সারা দেশে ৩০ বছর ধরে ঢাক বাজাচ্ছেন প্রিয়লালবাবু। বলেন, “দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজাই। সবাই মেতে ওঠেন। কিন্তু আমাদের কথা ভাবে কে?”
তবে সংগঠনটা হওয়ার পরে হতাশা কমেছে কিছুটা। কিছু জায়গায় প্রদর্শনী হয়েছে, কাজ মিলেছে। পুরস্কারও মিলেছে বেশ কিছু। এখন ওঁদের একটাই আশা, সরকার থেকে যদি একটু উদ্যোগ নেওয়া হয় শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। প্রিয়লালবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী তো দুঃস্থ শিল্পীদের সাহায্য করছেন। আমাদের করবেন না?” |