তিন ফুট বাই চার ফুটের পিতল আর অ্যালুমিনিয়ামের আয়তাকার ক্যানভাস। তার উপর একটু একটু করে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে গ্রামবাংলার লোকজীবন কাব্য। আছে রামায়ণ-মহাভারতের দৃশ্যও। ধাতব পাতে এ সব ফুটে উঠেছে নবদ্বীপের হারিয়ে যেতে বসা কাঁসা-পিতল শিল্পের এক বিশেষ নির্মাণশৈলী “ঠোকাই” পদ্ধতিতে সরু মোটা নানা ধরনের লোহার ছেনি, যার মাথা ভোঁতা, কাঠের হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে পিতলের ধাতব পাতের উপর নজরকাড়া নকশা আঁকতেন এখানকার পিতল-কাঁসার কারিগরেরা। সেই হারিয়ে যাওয়া ‘‘ঠোকাই’’ পদ্ধতিতে এ বারের দুর্গাপুজোর মণ্ডপ তৈরি করছেন নবদ্বীপের শিল্পী রাজু সূত্রধর।
পাতের গায়ে হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে ফুটিয়ে তুলতে হয় নকশা। তাই নাম ঠোকাই পদ্ধতি। স্থানীয় ইতিহাস গবেষকরা জানাচ্ছেন, চৈতন্যজন্মের অনেক আগে থেকেই নবদ্বীপ কাঁসা-পিতল শিল্পের জন্য সারা ভারতে পরিচিত ছিল। ঠোকাই পদ্ধতির প্রয়োগ নবদ্বীপের এই শিল্পকে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে খ্যাতির শীর্ষে রেখেছিল। বিগত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে ধীরে ধীরে পিতল-কাঁসার প্রচলন বন্ধ হয়ে যায়। নবদ্বীপের কয়েকশো পরিবার পুরুষানুক্রমে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বটে, তবে কাঁসা-পিতল আর তাঁদের পেট ভরাতে পারছে না।
তবু রাজুর মতো শিল্পীও আছেন। বললেন, “ইতিহাসের শহর নবদ্বীপের অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম তাঁত আর কাঁসা-পিতল। এখানকার সম্তান হয়ে আমি সকলকে দেখাতে চাই, সেকালের পিতল-কাঁসার শিল্পীরা কতটা দক্ষ ছিলেন তাদের নিজস্ব মাধ্যমে।” মালদহের সর্বজয়ী ক্লাবের জন্য রাজু তৈরি করছেন এই মণ্ডপ। প্রায় দশ লক্ষ টাকা বাজেট। আন্দামান থেকে ত্রিপুরা সর্বত্র মণ্ডপের কাজ করে নজর কেড়েছেন রাজু। ২০১২ সালে বাংলার সেরা মণ্ডপ তৈরির জন্য “আনন্দবাজার-পার্লে” পুরস্কার পেয়েছিল রাজুর তৈরি শিলিগুড়ি রথতলা ক্লাবের মণ্ডপ।
এ বারের মণ্ডপ সম্পর্কে রাজু বলেন, “মূল মণ্ডপটি ৪৩ ফুট উঁচু। গোটা মণ্ডপ জুড়ে থাকবে পিতল আর অ্যালুমিনিয়ামের প্যানেলে ঠোকাই করে রূপসী বাংলার নানান দৃশ্য। মোট পাঁচ কুইন্ট্যাল পাত ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি ছাড়া ১৩ জন কারিগর প্রায় আড়াই মাস ধরে প্যানেলগুলি তৈরি করেছেন। প্রথমে আমি লাইন ড্রয়িং করে দিয়েছি। তারপর নানা ধরনের ছেনি দিয়ে ঠুকে ঠুকে তৈরি করা হয়েছে রূপসী বাংলার ধাতব কাব্য।”
এই মণ্ডপ ছাড়াও রাজু গঙ্গারামপুরে দুটো এবং বালুরঘাটে একটি মণ্ডপ তৈরি করছেন। তিনি বলেন, “মধ্যে গঙ্গারামপুরে চিত্তরঞ্জন ক্লাবের মণ্ডপটি করছি কাঠের ব্লকের উপর খোদাই করে। গঙ্গারামপুর ফুটবল ক্লাব আর বালুরঘাটের মণ্ডপ দুটি শিল্প মাধ্যমে তৈরি করছি। পুতুল, মুখোশ, কাঠ থেকে মাদুর সব ব্যবহার করছি। তবে হারিয়ে যেতে বসা নানা জিনিসকে উৎসবের আঙিনায় সকলের সামনে নতুন করে উপস্থাপন করতেই আমি ভালবাসি।” রাজু জানান, দু’বছর আগে ত্রিপুরায় মণ্ডপ করেছিলেন তাঁতের শাড়ি দিয়ে।”
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিঞ্জন দেব বলেন, “পিতল-কাঁসার সুদিন নবদ্বীপে চৈতন্যজন্মের বহু আগে থেকেই ছিল। অষ্টাদশ শতকে এর ব্যাপক সাড়া ভারতে ছড়ায়। নবদ্বীপের উপর লেখা অন্যতম প্রামাণ্য বই ‘নবদ্বীপ মহিমা’তে কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী লিখেছেন, ১৮ শতকের গোড়ার দিকে নবদ্বীপের কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ী গুরুদাস দাসের সারা ভারতে মোট ৮০০ জায়গায় দোকান ছিল। তাঁর তখন বার্ষিক উপার্জন ছিল এক কোটি টাকা। সবই কাঁসা-পিতলের সৌজন্যে।”
পুজো মণ্ডপের অলঙ্করণে হারানো পিতল-কাঁসার নির্মাণশৈলী কি আজকের মেলামাইন-ফাইবার যুগে কোনও ছাপ ফেলতে পারবে? সময় বলবে সে কথা। |