প্রতি বছরই এমন হয়। পুজো বা ঈদের আগে কাজ হারান ওঁরা। সারা রাত কাজ করে সকালে মিল থেকে বেরোনোর সময়ে দেখেন কাজ বন্ধের নোটিস পড়ে গিয়েছে মিলে।
এই যেমন হল ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে, হুগলির গোন্দলপাড়া জুটমিলে। রাতের বেলা বি শিফ্টে কাজ করছিলেন শ্রমিকেরা। মিলের গেটে তত ক্ষণে ঝুলে গিয়েছে কাজ বন্ধের নোটিস। শ্রমিকদের অজান্তেই মিলের প্রধান ফটক দিয়ে পুলিশ প্রহরায় যাবতীয় পণ্য বার করে নিয়ে গিয়েছেন মালিকপক্ষ। এ বার মিল বন্ধ ঠেকায় কে? অথচ, আইন বলে ‘সাসপেনশন অফ ওয়াকের্’র নোটিস ঝোলাতে হলে অন্তত এক মাস আগে তা শ্রমিকদের জানাতে হয়। কিন্তু নিয়মের ধার আর কে-ই বা ধারে? তাই ও সব প্রশ্ন আর তেমন করেন না গোন্দলপাড়া জুটমিলের হাজার পাঁচেক শ্রমিক। তাঁদের কারওর খাতায় নাম আছে, কারও নেই। একই পরিশ্রমে কেউ পায় ২৩০ টাকা, কেউ ৩৩০ টাকা রোজ। |
খাতায় নাম রয়েছে বছর সত্তরের রেজাউল করিমের। পঞ্চাশ বছর আগে মিলে কাজ করতে এসেছিলেন বিহার থেকে। কুড়ি বছর বয়সে কাজে ঢুকেছেন মিলে। তখন মিলের মালিক ছিল অন্য কেউ। পরে মালিক বদলালেও, এত বছর কাজ করছেন যখন, গ্র্যাচুইটি নিশ্চয়ই পাবেন। সেই আশায় পঞ্চাশ বছর মজদুরি করার পরও ছুটি নিচ্ছেন না। রেজাউল বললেন, “বিহারে খেতিবাড়ি রয়েছে কিছু। এক ছেলে, দুই মেয়ে। তাদের বিয়ে দিতে হবে। গ্র্যাচুইটির টাকা পাইনি। গ্র্যাচুইটি পাওয়ার আশায় এখনও কাজ করেই চলেছি।” যদিও শ্রমিক লাইনে কান পাতলে কানাঘুষো শোনা যায়, গত বছর মিলের অন্তত হাজার খানেক শ্রমিক অবসর পেলেও এক টাকাও গ্র্যাচুইটি পাননি। যারা পেয়েছেন, তাদেরও জুটেছে অতি সামান্য। যার দেড় লক্ষ টাকা পাওনা, হাজার তিরিশেক নিয়েই তাকে ঘাড় নাড়তে হয়েছে, এমনও শোনা যাচ্ছে।
পুজোর আগে নানা চটকল বন্ধ হয়ে যায়। আর তখনই শ্রমিকদের মধ্যে নানা গুঞ্জন ওঠে। পুজো কেটে গেলেও কবে যে মিল খুলবে, ঠিক থাকে না। ২০১০ সালে গোন্দলপাড়ায় পুজোর আগে বন্ধ হওয়ার পর সাত মাস মিল খোলেনি। তার কয়েক দিন পরে ২০১১ সালের মার্চেও তিন মাসের জন্য বন্ধ হল মিল। শ্রমিকদের বোনাস তো মেলেই না, মেলে ‘শো কজ’ চিঠি, পুলিশের রেড, হাজতবাস, কারাদণ্ড। এ বছরও নাকি শ্রমিক লাইনে পুলিশ রেড শুরু হয়ে গিয়েছে, তবে এখনও জেলে যায়নি কেউ।
রামলাল সাউ নামে বছর ষাটের এক শ্রমিক বলেন, “রোজ বলে, প্রোডাকশন কম হচ্ছে, কম হচ্ছে। মজদুর আর কত খাটবে? সেই পুরনো আমলের মেশিন। সারাক্ষণ মিলের ভিতর দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। একটু ভুল হলে গালি শুনতে হয়। মিলের ভিতর ইজ্জত নেই। তবু শান্তিতে কাজ করতে চাই। কারখানা বন্ধ হলে আমাদেরই পেটে টান পড়ে।”
বছর চল্লিশের অলোক প্রসাদের চেহারা দেখে যে কেউ পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রৌঢ় বলে ভুল করতে পারেন। থাকেন গঙ্গার ঘাটে। মিলের কোয়ার্টার জোটেনি এখনও। খুব বেশি দিন অবশ্য কাজ করছেন না মিলে। কিন্তু নানা ছোটখাটো ব্যবসা করার পর মিলে একটা ‘পাকা নকরি’র বন্দোবস্ত হল, তখন বেশ খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু কাজ হারিয়ে অকুস্থলে। বললেন, “এ বার কী করব জানি না। উত্তর ২৪ পরগনার এক মিলে কাজ করে আমার বন্ধু। তাকে বলেছি, যদি ঢোকা যায়। কিন্তু পুজোর আগে কাজ দেবে কে?”
পুজোর বাজার, পুজোর আনন্দ, পুজোর খাওয়াদাওয়া, এ কথাগুলোই তাই অর্থহীন এই সব শ্রমিকের কাছে। |