|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
লালদিঘির লালবাড়ি |
সেই শুরু থেকে কখনও ছুটি মেলেনি রাইটার্স বিল্ডিংসের, আদি বাড়ির আকৃতি
বেড়েছে
নতুন নতুন
অধীশ্বরের
খেয়াল ও প্রয়োজন মতন। অবশেষে, যা দুশো
বছরে
কেউ ভাবতেও
সাহস করেনি তা বাস্তব হতে চলেছে। লিখছেন
শংকর |
হাজার বিষয়ে হাজার হাজার পাতার বই লিখে ফেলেছি আমরা, কিন্তু ভাবতে আশ্চর্য লাগে, কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংস নিয়ে পাতে দেবার মতো কোনও সাহিত্যকর্ম আজও নেই। বিদেশ থেকে আসা সাহেব সাংবাদিকরাও আশ্চর্য হয়ে যান— যে প্রাসাদে রাজত্ব করেন ক্লার্ক অথবা কেরানিরা, তার নাম কেন ‘রাইটার্স’ হল? তাঁদের এক জন আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের রসবোধ অনন্ত, বেন্টিংক স্ট্রিটের ইনকাম ট্যাক্স হেডকোয়ার্টার্সের নাম দিতে পেরেছ ‘প্যারাডাইস’! আত্মনিপীড়নকারী এক বাঙালি ব্যাখ্যা করেছিলেন, রাইটার্সে শুধু ফাইলে লেখালিখি হয়, তাই রাইটার্স, যে দিন ওখানে লেখার বাইরে কিছু কাজকর্ম হবে সে দিন নাম পাল্টাবার প্রয়োজন হবে।
চুপিচুপি নতুন একটা নামকরণের চেষ্টা চলেছে সেই সাতচল্লিশ সাল থেকে— মহাকরণ, কিন্তু কট্টর বাঙালি জনমানসে তা দাগ কাটেনি, রাইটার্স রাইটার্সই থেকে গিয়েছে। অনেকের এখনও ভুল ধারণা রয়েছে, বড় বড় রাইটারদের ওখানে বিনামূল্যে ঘর ভাড়া দিয়ে সম্মানিত করা হয়, যেমন প্যারিসে আর্টিস্টদের কনসেশনে ঘর ভাড়া দিয়ে সম্মান দেখানো হয়।
বহু যুগ আগে পিতৃদেবের অকালমৃত্যুর পরে মায়ের মুখে হাসি ফোটাবার জন্যে হাওড়া থেকে চুপিচুপি ডালহৌসিতে এসে লালবাড়ির আশেপাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘোরাঘুরি করেছি। ওই বাড়িতে ঢুকবার চেষ্টাও করেছি, কিন্তু তখনও প্রবেশে বড়ই কড়াকড়ি, কাউন্টারে গেলেই প্রশ্ন করেছে, কার সঙ্গে দেখা করবেন? কিন্তু চিফ মিনিস্টার ছাড়া কারও নামই আমার জানা নেই। ফলে দেখা হয়নি। |
|
তবে ক্যানটিনে বসে ‘রাইটার্স’ শব্দটির রহস্য জেনে ফেলেছি শ্রদ্ধেয় দাদাদের কাছ থেকে। জন কোম্পানির সদ্য ইমপোর্টেড সাহেব ছোকরাদের ক্লার্ক না বলে রাইটার বলা হত এবং রাজধানীতে তাঁদের বসবাসের প্রথম ঠিকানা এই লালবাড়ি। এঁরা তখনও ব্যাচেলর, কিন্তু মাসিক মাইনে কুড়ি টাকার মতন। নিষ্ঠুর ইংরেজ শুধু বঙ্গলুণ্ঠন করেনি, নিজের ছেলেদেরও লজ্জাকর মাইনে দিয়ে শোষণ করবার চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু মাইনে কম হলেই কীর্তি কম হয় না, রবার্ট ক্লাইভ তো এই কেরানি দলেই ছিলেন।
আমাদের পকেটে পয়সা ছিল না, কিন্তু ক্যানটিনে তখন চেয়ার অকুপাই না করেও রসিক দাদাদের অনেক গল্প শোনা যেত। এই জন কোম্পানিই যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদরের ডাকনাম, তা তখনকার রাইটার্সের অভিজ্ঞ কেরানিরা ভাল ভাবে জানতেন। তখন যাঁরা সিনিয়র ক্লার্ক হতেন তাঁদের অনেকেরই আজকের আই এ এস হওয়ার যোগ্যতা ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার আগে সে সব পোস্ট কেবলমাত্র সাহেবদের জন্য। আগে হিংসে করতাম, পরে জানলাম এঁদের উপার্জন এমন কিছু লোভনীয় ছিল না— অন্তত যাঁরা সোজা আঙুলে ঘি তোলায় বিশ্বাস করতেন।
লোকমুখে জন কোম্পানির ছোকরা সাহেবদের যে সব গল্প শুনতাম, তা রাইটার্স বিল্ডিংসের ধারাবাহিকতাকে মহিমান্বিত করে না। স্বল্প মাইনের সাহেবরা আর কোথায় যাবেন! রাইটার্সেই কাজকর্ম, ওইখানেই ভোজনাদি এবং বসবাস। শুনে সুখী হয়েছিলাম, এঁরাই বঙ্গীয় মুড়িকে নতুন মহিমা দিয়েছিলেন। পেটে টান পড়লে খরচসচেতন ছোকরা ইংরেজদের প্রিয় আইটেম ছিল মুড়ি, যার নতুন নাম হয়েছিল ইন্ডিয়ান বিস্কুট।
রাইটার্স বিল্ডিংসে বেয়ারা পদের জন্যে কয়েক বার আবেদনপত্র পাঠিয়েছি, এক বার তিন তলায় ইন্টারভিউও দিয়েছি, কিন্তু শিকে ছেঁড়েনি, প্রধান কারণ আমার তখনও আঠারো বছর বয়স হয়নি। যথাসময় ক্যানটিন সার্কেল থেকে পরামর্শ এল, আবেদনপত্রে জন্মতারিখ লিখো না, এবং ম্যাট্রিক পাশের সার্টিফিকেটটা লোকচক্ষুতে না এনে নিজেকে ‘নন-ম্যাট্রিক’ বোলো। এ বার ভাগ্যের দেবী সুপ্রসন্ন হলেন, বাঁকুড়া বাজারে একটা টেম্পোরারি বেয়ারার চাকরি জুটতে পারে রাজকীয় বাহান্ন টাকা মাইনেতে, কিন্তু ব্যবস্থাপকদের তিনশো বারো টাকা অগ্রিম প্রাপ্য। এর সঙ্গে বাঁকুড়ার ট্রেনভাড়া— নিয়োগপত্র ওখান থেকেই সংগ্রহ করতে হবে, এবং থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করা। হিসেব করে দেখলুম, হাওড়ার সংসারে আমি আগামী দেড় বছরে কোনও কাজেই লাগব না। সুযোগটার সদ্ব্যবহার করা গেল না।
বহু বছর পরে এক জাঁদরেল আই এ এস সেক্রেটারি আমাকে প্রফেশনাল পরামর্শের জন্যে ডেকেছিলেন এবং গুণগ্রাহী সেই ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘আমরা তো আপনাদের মতন উপদেষ্টা অ্যাফোর্ড করতে পারি না!’ মনের দুঃখ চেপে রাখতে না পেরে সেই উদারহৃদয় সেক্রেটারিকে জানিয়েছিলাম আমার বেয়ারার চাকরি পাবার প্রয়াসের কথা, বলেছিলাম, ‘আপনার চোখের সামনে এই অফিসেই অনেক ‘একসেপশনাল’ পার্সন বসে আছে, কিন্তু সিস্টেম কোনও কারণে তাদের কাজে লাগাতে পারেনি।’
ফিরে যাই মহাকরণের আশেপাশে আমার চাকরি সন্ধানের দিনগুলোতে। রাইটার্সের চার ধারে আশেপাশে তখনও ডজন ডজন বিলিতি বিজনেস হাউস, তাঁরা জুটের রাজা, টি-এর রানি, পেপার মিলের অধীশ্বর, ব্যাঙ্কিং, ইনশুয়োরেন্স বা শিপিংয়ের অধীশ্বর। তবু রাইটার্সের কেরানির সঙ্গে মার্চেন্ট হাউসের কেরানির আকাশপাতাল তফাত। স্বয়ং ঠাকুর রামকৃষ্ণও রহস্যটা বুঝেছিলেন, কেউ এলে জিজ্ঞেস করতেন, ‘পেন্সিল’, মানে পেনশন আছে কি না। চাকরিতে পেন্সিল থাকা না থাকায় আকাশপাতাল তফাত!
অবশেষে আমার অন্ন জুটেছে হাইকোর্টের আদালতি পাড়ায়। ইংরেজ ব্যারিস্টার মাঝে মাঝে চিফ সেক্রেটারি, হোম সেক্রেটারি, ফিনান্স সেক্রেটারির কাছে মক্কেলদের হয়ে সওয়াল করতে যেতেন। ব্যারিস্টারের বাবু হিসেবে আমিও একাধিক ব্রিফ হাতে ক্ষমতার অলিন্দে যাতায়াত করেছি। রাইটার্সে যাওয়ার আগে ব্যারিস্টারি রীতিতে সাহেব যে দীর্ঘ আবেদনপত্রটি ডিকটেট করতেন, কোনও অজ্ঞাত কারণে তার নাম ‘এড মেময়ার’, যার বাংলা দাঁড়ায় ‘স্মরণে সাহায্যকারী’ অর্থাৎ রাইটার্সের বহু যুগের ধারাবাহিকতা হল এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বার করে দেওয়া, লর্ড ক্লাইভ থেকে আরম্ভ করে ওয়ারেন হেস্টিংস ইত্যাদি কেউই স্মৃতিশক্তির জন্য বিখ্যাত নন! তাই অভিজ্ঞ ইংরেজ আইনজ্ঞরা সেই আদি থেকে শক্তিমানদের ঘর থেকে বেরোবার সময় একটা সুলিখিত প্রাণবন্ত বিস্মৃতিরোধক আবেদনপত্র বা যুক্তিপত্র যথাস্থানে রেখে আসতেন।
সেই ক্লাইভের আমল থেকে সে কালের কলকাতার নানা গল্পের স্বর্ণখনি ছিলেন ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল সাহেব। জন কোম্পানির ছোকরা সাহেবদের অনেক খবর তাঁর জানা ছিল। যেমন মাইনে নামমাত্র হলেও এই সাহেবরা রাইটার্সে এসেই এক এক জন মুনসি নিয়োগ করতেন। এই আকাঙ্ক্ষিত পদের জন্য বাঙালিদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। এঁরা সাহেবের বাজার সরকারও বটে, বেনিয়ানও বটে, অর্থের জোগানদারও বটে। আজ্ঞে হ্যাঁ, সাহেবরা ধারও করতেন, আবার হিসেব-বহির্ভূত রোজগারও করতেন, বেনামে দু’নম্বরি ব্যবসাও করতেন। কেউ দ্রুত ভাগ্য ফিরিয়ে ফেলতেন, আবার বাউন্ডুলে অবস্থায় কেউ অদৃশ্য হয়ে যেতেন।
শোনা যায়, রাইটার্সের দৌলতেই এঁদের নাম হয়েছিল RICH অর্থাৎ ‘রব ইন্ডিয়া কাম হোম’ বয়েজ। তখনকার রাইটার্সে ইংরেজ সাহেবদের সব ব্যাপারে ব্যস্ততা, কারণ কলকাতায় সাহেবদের গড় পরমায়ু সামান্য কয়েক বছর, পেটের গোলমাল, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, এই সব এড়িয়ে বেঁচে থাকাটাই মস্ত ঝুঁকি। লালবাড়ির দু’নম্বরি রোজগার এক বার জাহাজে তুলে নিয়ে স্বদেশে পৌঁছতে পারলে শান্তি, বিলেতের মাটিতে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে বসবাস করে অনেকে সেখানে দীর্ঘজীবীও হয়েছেন।
চাকরির বাইরে রোজগারের অনন্ত সুযোগ লালদিঘির লালবাড়িতে। তবু কিছু সুখ থেকে ইংলন্ডেশ্বরী তাঁর সন্তানদের বঞ্চিত করেছেন— এই শহরে বাড়িঘর কেনা এবং স্থানীয় মেয়ে বিয়ে করা নিষিদ্ধ। আমেরিকায় সাহেবরাই স্বদেশের সাহেবদের মেরে তাড়িয়ে দিয়ে অনুগত ইংরেজের মনে প্রবল কষ্ট দিয়েছে। |
|
তার পর মিউটিনির দৌলতে অনেক পরিবর্তন— জন কোম্পানির বদলে উচ্চশিক্ষিত কম্পিটিশনওয়ালারা স্বদেশ থেকে এসে রানির শাসনদায়িত্ব গ্রহণ করেছে। যারা জন কোম্পানির একতরফা ব্যবসায় ভাগ বসিয়েছে তাদের নতুন নাম হয়েছে ‘বক্সওয়ালা’, রাইটার্সের চার পাশে বড় বড় বিজনেস হাউসে স্থান নিয়ে তারা বহু দশক ধরে ভোগসুখের মধ্যে থেকেছে, পাশের বাড়ি রয়াল এক্সচেঞ্জে এঁদের কিছু তৈলচিত্র আজও দেখতে পাবেন।
জীবনের শেষ পর্বে ডালহৌসির সাহেব ব্যবসায়ীরা বিশেষ কারণে বারওয়েল সাহেবকে ব্রিফ পাঠানো বন্ধ করেছেন। তখন তাঁর শরীরও খারাপ। খেয়ালের বশে পূর্বপুরুষদের স্মৃতিচিহ্ন দেখাতে এক দিন আমাকে নিয়ে কলকাতা ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। এক জন রিচার্ড বারওয়েল ওয়ারেন হেস্টিংসের ডান হাত হয়ে বিপুল বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন। সে বার এক সময় আমাদের গাড়ি লালদিঘি এড়িয়ে রাইটার্সের সামনে দাঁড়াল। সাহেব হঠাৎ বললেন, ‘আমাদের তো ছেলে নেই, তুমিই আমার বংশধরের মতন। ইচ্ছে ছিল তোমার জন্যে কিছু রেখে যাই। এই যে রাইটার্স দেখছ, এটির মালিক ছিলেন রিচার্ড বারওয়েল। বংশানুক্রমে এটার মালিকানা থাকলে আমার এবং তোমার কোনও কষ্ট থাকত না। ভেবে দেখ আজকের দরে এর মাসিক ভাড়া কত হতে পারত। কী একটা ঘটেছিল, আমার পূর্বপুরুষ রাইটার্সের মালিকানা অতি সামান্য দামে কোম্পানিকে বেচে দিলেন। আমি ও তুমি কলকাতার এই এক নম্বর প্রপার্টির মালিক হতে গিয়েও আয়ত্তের বাইরে চলে গেল!’ সে এক বিপুল একসাইটমেন্ট। হাওড়া চৌধুরীবাগানের কানাগলির ভাড়াটে বাড়ি থেকে খাস রাইটার্স বিল্ডিংসের সম্ভাব্য মালিকানা!
এর কিছু দিন পরে বারওয়েল সাহেব যখন এক দিন বিত্তহীন অবস্থায় হঠাৎ চলে গেলেন, তখন রাইটার্সের সামনে দাঁড়ালেই মনের অবস্থা পালটে যেত। সেই সময় এক দালালের সঙ্গে আলাপ হয়, কলকাতার সাহেব বাড়ি ভাঙা হলে সে বার্মা টিকের কড়িবরগা দরজা জানালা ইতালিয়ান পাথরের দালালি করত। আমার দালাল বন্ধুর সময় ভাল যাচ্ছিল না, এই শহরের প্রায় সব সাহেব বাড়িই ভেঙে বেচে দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হল, এই ভদ্রলোক লোলুপ হয়ে জেনুইন সাহেববাড়ি রাইটার্স বিল্ডিংস ভাঙলে কত ভ্যালুয়েশন হতে পারে তার হিসেব করছিল। আমার ব্যাপারটা ভাল লাগেনি, ওর জানা উচিত এইটাই আমাদের রাজধানী এবং এইটাই আমাদের শেষ রাজপ্রাসাদ যা এক দিন আমারও হতে পারত।
পলাশির যুদ্ধের পর আমরা বাঙালিরা কত বিষয়ে কত অভিধান, সংকলন, ইতিহাস লিখে ফেললাম, কিন্তু যে বাড়িটা অন্তহীন অহংকারে এত দিন ধরে আমাদের সব কর্ম, অপকর্ম ও দুঃখের উৎস হয়ে রইল এবং যেখান থেকে আমরা শাসিত হলাম, তার সম্বন্ধে পাঠযোগ্য কোনও পুস্তক রচিত হল না। সাহেবরাও কোনও অজ্ঞাত কারণে আশ্চর্য এই বাড়িটার ভিতরের কথা লিপিবদ্ধ করলেন না। শুধু আমরা জানলাম, সময়ের স্রোতের সঙ্গে তাল রেখে এখানকার ভাগ্যবিধাতারা মাঝে মাঝে তাঁদের মন ও মেজাজ পালটেছেন। জন কোম্পানির বক্সওয়ালারা এবং রানির আমলে বিলেত থেকে সদ্য ইমপোর্টেড কম্পিটিশনওয়ালা আই সি এস বা তাঁদের ছোট মেজ বড়বাবুরা এক নন। শোনা যায়, রেড টেপ বা লাল ফিতে শব্দটির জন্ম এই রাইটার্সে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাহেবদের মনোরঞ্জনের জন্য ‘জো হুকুম’ বঙ্গীয় বাবুদের সে কী ব্যাকুলতা! বাবুদের সারাক্ষণের আরাধ্য দেবতা হিসেবে যাঁর নাম শোনা যায় তিনি মহাত্মা ওয়েকফিল্ড। যুগ যুগ ধরে যত গ্রিজ এখানে ব্যবহৃত হয়েছে তার উদ্ধারে অয়েল কোম্পানিকে আমন্ত্রণের কথাও ভাবতেন এক কালের বিদ্রোহী বাঙালি। রাইটার্সের সাহেবরা কিন্তু খুবই সিরিয়াসলি তাঁদের দায়দায়িত্ব পালন করতেন ‘ইয়োরস মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সারভেন্ট’ হিসেবে। রাজকীয় ঔদ্ধত্যের সঙ্গে এমন কার্মিক বিনয় পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
সাহেবরা কবে ট্রান্সফার হতেন, কবে ‘ফারলো’তে যেতেন, তার প্রতিটি বৃত্তান্ত সরকারি গেজেটের পাতায় ছাপা অবস্থায় রয়েছে। আমরা শুনি, রাইটার্স ছেড়ে চলে যাওয়ার এক মাস আগে থেকে সাহেবরা বিরাট এক কাজে ডুবে থাকতেন— অধস্তন সব কর্মী নতমস্তকে বিদায়ী সাহেবের কাছ থেকে একটা লিখিত সার্টিফিকেট ভিক্ষা করতেন, সাহেব ধৈর্যসহকারে নিজের ঝরনা কলমে লিখতেন, ‘বাবু অমুককে গত এক বছর আমি মেজবাবু হিসেবে চিনি, এই বিনয়ী, পরিশ্রমী, বিচক্ষণ ও অনুগত মানুষটির উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি।’ এই সার্টিফিকেটটি মেজবাবুর মূল্যবান পারিবারিক সংগ্রহে চলে যেত। আরও কিছু উত্তেজক রূপকথা চালু ছিল। কোন গুণগ্রাহী সাহেব তাঁর প্রিয় বড়বাবুর জন্যে আলিপুরের নিলামে ওড়িশার জমিদারি কিনে এনেছেন প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ হিসেবে! আবার এই পরিবেশে ব্রাউন চাটুজ্যেবাবু সাহেবের পরম ভক্ত হলেও তাঁর স্পর্শ করা খানা খাওয়ার কথা ভাবতেও পারতেন না। ইস্ট-ওয়েস্ট এত কাছে এসেও ডিনার টেবিলের সামনে ইঙ্গ-ভারতীয় ইতিহাস থমকে দাঁড়াত।
সাতচল্লিশের স্বাধীনতাও এই দূরত্ব ভাঙতে পারেনি। ব্রাউন আই সি এস অথবা পরবর্তী সময়ে ব্রাউন আই এ এসও যে মহাত্মা ওয়েকফিল্ডকে রাইটার্স থেকে বিতাড়িত করতে পারেনি, তার অসংখ্য প্রমাণ ফাইলের মহাফেজখানায় আজও জড়ো হয়ে রয়েছে অনুসন্ধিৎসুদের জন্যে।
তার পরও তো কত সময় কাটল। পরিচিত সাংবাদিক এবং প্রবীণ সেক্রেটারিদের কাছ থেকে মহাকরণের মহানায়কদের কত কথাই তো শুনেছি, কেউ কেউ তো ইতিহাসের চরিত্রও হয়ে উঠেছেন, বিশেষ করে বিধানচন্দ্র রায় এবং দেশবন্ধুর নাতি, আমাদের হাইকোর্ট পাড়ার প্রিয় চরিত্র মানু রায়। লালবাড়ির ইতিহাসে বিধানচন্দ্রই বোধহয় বিশালকায় ডাইনোসরের মতন আঁকা হয়ে আছেন তাঁর দূরদৃষ্টি ও পরিচালনক্ষমতার জন্য— একই সঙ্গে তাঁর আদি পেশার জন্য, রাইটার্সের করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে সুইপারের কাশির শব্দ শুনে তিনি নাকি তার সিরিয়াস ব্যাধির ডায়াগনসিস করে ফেলেছিলেন। সিদ্ধার্থ রায়ের নাকি ঘুম আসত না, মধ্যরাতেও চিফ মিনিস্টারের ঘরে আলো জ্বলত এবং তিনি একাদিক্রমে টেলিফোন করে যেতেন। আর এক জন, জ্যোতি বসু তো সময়ের পরিমাপে ম্যারাথন দৌড় দিয়েছেন, প্রমাণ করেছেন এক অঙ্গে পরস্পরবিরোধী গুণের আশ্চর্য সহ-অবস্থিতি সহজেই ঘটতে পারে, সর্বহারার বিপ্লবের পূজারীও একই সঙ্গে হতে পারেন সংসদীয় গণতন্ত্রের হোলটাইম পূজারী। তার পরেও লালবাড়ির লাল সিংহাসনে অধিষ্ঠান করেছেন দুই বিচিত্র পুরুষ ও নারী। এক জন কমরেড ক্যাপিটালিস্ট বিজনেসম্যানকে পছন্দসই জমির দখল দিতে ব্যর্থ হয়ে নতমস্তকে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেলেন, আর এক জন ছোট্ট ন্যানোকে ম্যাগনাম সমস্যায় পরিণত করতে সফল হয়ে মা মাটি মানুষের পূজারিণী হয়ে লালবাড়ির হৃদয়েশ্বরী হয়ে লালবাড়ি থেকে সাময়িক ভাবে সরে যাওয়ার দুঃসাহস দেখালেন।
আশ্চর্য সব পরস্পরবিরোধী ঘটনার প্রত্যাশিত এবং অপ্রত্যাশিত সংঘর্ষের নীরব সাক্ষী এই রাইটার্স। বহু শতাব্দীর বহু ঘটনা ও অঘটনের সীমাহীন বোঝায় ক্লান্ত এবং কিছুটা পঙ্গু তার শরীর।
সেই জন্মমুহূর্ত থেকে শুরু থেকে কখনও ছুটি মেলেনি রাইটার্স বিল্ডিংসের, রিচার্ড বারওয়েলের আদি বাড়ির আকৃতি কিন্তু বেড়েছে নতুন নতুন অধীশ্বরের খেয়ালখুশি ও প্রয়োজন মতন। বাংলার ভৌগোলিক আকার ও অর্থনৈতিক ওজন ক্রমশ যত কমেছে, রাইটার্সের আকার সেই অনুপাতে তত বেড়েছে। এ বার দায়িত্বশীলরা প্রয়োজন বোধ করেছেন লালবাড়ির আমূল সংস্কারের। যা দুশো বছরে কেউ ভাবতেও সাহস করেনি তা এ বার বাস্তব হতে চলেছে।
নদীর ও পারে হাওড়া মন্দিরতলার ঠিকানা খুঁজে পাওয়ায় আগামী কিছু দিন আর বলা চলবে না— কলকাতা আছে কলকাতাতেই। পাঁচশো বছরের পুরনো হাওড়ায় বাংলার নতুন রাজধানীকে সুস্বাগতম্। সবাই মিলে বলুন: শুভায় ভবতু। |
|
|
|
|
|