|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
অগ্রাধিকার |
মঙ্গলবার ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পটির উদ্বোধন করিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কেবল কিশোরী কন্যাদের জন্য এই বৃহৎ প্রকল্পটির পরিকল্পনা করা হইয়াছে। বাস্তবে ইহার প্রয়োগে কী কী সমস্যা দেখা দিবে, ইহার উদ্দেশ্য পূরণ করা সম্ভব হইবে কি না, তাহা লইয়া সংশয় থাকিবেই। প্রাপক নির্বাচন এবং অনুদান বিতরণের প্রক্রিয়ায় উত্তরোত্তর নূতন নূতন বাধা উপস্থিত হইতে পারে, দুর্নীতি ও প্রবঞ্চনার অভিযোগ উঠিতে পারে। নীতির প্রশ্নও উঠিতে পারে: এমন ব্যাপক হারে ব্যক্তিগত অনুদান না দিয়া শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সার্বিক পরিকাঠামোর উন্নয়ন করাই কি সরকারের উচিত নহে? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রকল্পটির পক্ষেও এই যুক্তি দেওয়া যায় যে, বিশেষ কিছু সমস্যা বিশেষ কিছু ব্যবস্থা দাবি করে। বালিকাবিবাহ সমাজে এমনই গভীর শিকড় গাড়িয়া বসিয়াছে, যে কেবল অধিকতর স্কুল, অধিকতর শিক্ষক জুগাইয়া তাহার অবসান করা সম্ভব নহে। সর্বশিক্ষা অভিযানের মতো প্রকল্পের জন্য প্রাথমিক এবং জুনিয়র হাই স্কুলগুলিতে ছাত্র বাড়িয়াছে, কিন্তু স্কুলের উঁচু শ্রেণিতে উঠিবার পূর্বে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী আজও স্কুলছাড়া হইতেছে। ২০০৫-০৬ সালে জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষায় প্রকাশ, ১১ বছর হইতে ১৪ বৎসরের কন্যাদের ৭০ শতাংশ স্কুলে যাইতেছে, কিন্তু ১৫-১৭ বছরের কিশোরীদের মাত্র ৩৪ শতাংশ স্কুলে পড়িতেছে। তাহাদের একটি বড় অংশের বিবাহ হইয়া যাইতেছে। অপরিণত বয়সে বিবাহ, অপুষ্ট সন্তানের জন্ম, শিশুর দৈহিক-মানসিক খর্বতা এবং তজ্জনিত স্বল্প রোজগার— দারিদ্রের এই চক্র চলিয়া আসিতেছে। অপরিণত মায়ের অপুষ্ট সন্তান ভূমিষ্ঠ হইবার কারণে শিশুমৃত্যুর হারও কমিতেছে না। তৎসহ বালিকার বিবাহের জন্য পণপ্রথা, বধূনিগ্রহ, বধূহত্যার ন্যায় অপরাধগুলিও দীর্ঘায়িত হইতেছে।
কন্যাশ্রী প্রকল্প তাহার উদ্দেশ্যের কিয়দংশও যদি বাস্তবায়িত করে, তাহা যে সমাজের মুখ বদলাইয়া দিতে পারে। অকালবিবাহ, অকালপ্রসব এবং শিশুমৃত্যুর চক্রকে এক বার ভাঙিতে পারিলে সমাজের একটি বড় অংশকে ‘দারিদ্রের ফাঁদ’ হইতে মুক্তি দেওয়া যাইবে। যে মহিলা নিজে হাইস্কুলের গণ্ডি পার হইয়াছেন, তিনি নিজের কন্যাকে সহজে স্কুল হইতে বাহির করিয়া শিশুশ্রমিকে পরিণত করিবেন, তাহার সম্ভাবনা সামান্যই। বস্তুত প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা যে কয়েক হাজার করিয়া বাড়িতেছে, তাহার পিছনে সর্বশিক্ষা অভিযান, শিক্ষার অধিকার আইনের পাশাপাশি পরিবারের ভূমিকাও অনেক। গ্রামবাংলার অধিকাংশ পরিবারে বাবা-মা স্কুলের অন্তত পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণি অবধি পড়াশোনা করিয়াছেন, তাই পুত্রকন্যাকে আরও খানিকটা পড়াইতেছেন। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ যে প্রধানত মায়েরাই করিয়া থাকেন, তাহা সমাজবিজ্ঞানীদের নানা সমীক্ষাতেও দেখা গিয়াছে। ফলে কন্যাশ্রী প্রকল্প যদি কেবল কয়েকটি প্রজন্মের কিশোরীদের সহায়তা দিতে পারে, তাহা হইলেও ইহার সুফল সুদূরপ্রসারী হইবে, সন্দেহ নাই। অর্থ যখন সীমিত, আর তাহার উপর দাবি অগণিত, তখন কোন কাজে অর্থ ব্যয় হইবে সেই সিদ্ধান্ত আরও কঠিন হইয়া পড়ে। সাধারণত শিশু ও কিশোর, নারী, অতি-দরিদ্র প্রভৃতি শ্রেণিগুলি অবহেলিত হয়, কারণ তাহাদের দাবিগুলি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়া প্রবল হইয়া উঠিয়া আসে না। রাজ্য সরকার কিশোরীদের জন্য বিনিয়োগকে গুরুত্ব দিয়াছে। এই প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থ যাহাতে অপব্যবহৃত না হয়, তাহা নিশ্চিত করা জরুরি। |
|
|
|
|
|