রাহুলের দাবি মেনে অর্ডিন্যান্স ‘ছিঁড়ল’ কেন্দ্র, খারিজ বিলও
রাহুল গাঁধীর দাবি মেনে আজ বিতর্কিত অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করে নিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। শুধু অর্ডিন্যান্স নয়, দাগি সাংসদ-বিধায়কদের সদস্যপদ বাঁচাতে জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের সংশোধন চেয়ে যে বিল সংসদে পেশ করা হয়েছিল, তা-ও প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে।
আজ সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকের আগে সকালে কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠকে অর্ডিন্যান্স এবং বিল প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। রাহুলের মতামত মেনে নেন কংগ্রেসের শীর্ষ কমিটির সব সদস্যই। কোর গ্রুপের বৈঠকের পরে দুপুরে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী। বিকেলে শরিকদের জানান অর্ডিন্যান্স ও বিল প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অর্ডিন্যান্স এবং তার পর গত শুক্রবার রাহুলের তীব্র বিরোধিতার জেরে দল ও সরকারে যে অস্বস্তির আবহ তৈরি হয়েছিল, তা কাটাতে আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যান কংগ্রেস সহ-সভাপতি। শুক্রবারই আমেরিকা সফররত প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়ে তাঁর নেতৃত্বের উপরে আস্থা প্রকাশের পরে এ দিনও মনমোহনের ক্ষোভ নিরসনের চেষ্টা করেন রাহুল। গত কাল আমেরিকা থেকে ফেরার পথে বিমানে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, রাহুলের বক্তব্য নিয়ে আপত্তি না-থাকলেও ভাষা এবং মন্তব্যের সময় নিয়ে তাঁর উষ্মা রয়েছে। রাহুল আজ সেই ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করলেও এবং অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করালেও শেষ হাসি যে তিনিই হাসলেন এমন কথা কিন্তু বলা যাচ্ছে না।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বেরোনোর পথে। ছবি: পিটিআই।
কেন? কংগ্রেসের সকলেই প্রকাশ্যে রাহুলের পাশে দাঁড়ালেও তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়েছেন ইউপিএ শরিকরা। আজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শরদ পওয়ার, ফারুক আবদুল্লারা প্রশ্ন তুলেছেন, কংগ্রেসের কোর গ্রুপ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় একাধিক বার আলোচনার পর এই অর্ডিন্যান্স আনা হয়েছিল। তখন রাহুল কোথায় ছিলেন? সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার পরে রাহুল প্রকাশ্যে মুখ খোলায় ইউপিএ-কেই অস্বস্তির মুখে পড়তে হয়েছে। রাহুল তথা কংগ্রেসের মত মেনে নিলেও পওয়ার দাবি তুলেছেন, এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হওয়াই ভাল। কারণ এর ফলে প্রধানমন্ত্রী তথা গোটা মন্ত্রিসভার কর্তৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। তাঁর দল এনসিপি-র নেতা ডি পি ত্রিপাঠী রীতিমতো কটাক্ষের সুরে বলেছেন, “রাহুল গাঁধীর জানা উচিত, আমরা তাঁর অনুগামী নই, শরিক।”
ইউপিএ-র শরিক নেতারা মনে করছেন, ফৌজদারি মামলায় এমনকী নিম্ন আদালতেও দু’বছর বা তার বেশি সাজা পাওয়া মাত্র সাংসদ বা বিধায়ক পদ হারাবেন এই রায় দেওয়ার এক্তিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আছে কিনা, সেটা একটা আইনি প্রশ্ন। কিন্তু সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানাতে গিয়ে সরকার যা করেছে, তাতে জনমানসে এই বার্তা গিয়েছে যে, দাগি জনপ্রতিনিধিদের বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে।
অর্ডিন্যান্সটি তাঁর কাছে আসার পরে আপত্তি তুলেছিলেন রাষ্ট্রপতিও। সরকারের সঙ্গে সংঘাতে যাবেন না বলে তিনি অর্ডিন্যান্সটি ফেরত পাঠাননি। প্রধানমন্ত্রী দেশে না-থাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল শিন্দে এবং আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বলকে ডেকে পাঠিয়ে ব্যাখ্যা চান তিনি। তাতেও সন্তুষ্ট না-হয়ে প্রণববাবু আইনি পরামর্শও নেন।
শরিক নেতাদের মতে, প্রথমেই রাষ্ট্রপতির আপত্তি শুনলে এই অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হত না। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব রাষ্ট্রপতিকে সেই কৃতিত্ব দিতে চাননি। তাঁরা যখন বুঝতে পারলেন যে অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হচ্ছে, তখন রাহুলকে দিয়ে মুখ খুলিয়ে নিজেরাই কৃতিত্ব নিতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে সনিয়ারও সায় ছিল। কিন্তু রাহুল যে ভাবে অর্ডিন্যান্সকে ‘একেবারে ফালতু’ এবং ‘ওটা ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলা উচিত’ বলে মন্তব্য করেন তাতেই সমস্যা তৈরি হয়। বিতর্ক আরও দানা বাধে প্রধানমন্ত্রী বিদেশে থাকাকালীন তিনি এমন মন্তব্য করার ফলে। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে পড়েন প্রধানমন্ত্রী।
অথচ কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, মনমোহন কিন্তু সংসদকে উপেক্ষা করে এমন অর্ডিন্যান্স আনার বিরোধীই ছিলেন। কিন্তু লালুপ্রসাদ খোদ কংগ্রেস সভানেত্রীর কাছে গিয়ে আর্জি জানানোর পরে সনিয়ার সম্মতিতেই কংগ্রেস কোর গ্রুপ এবং মন্ত্রিসভা অর্ডিন্যান্স আনার সিদ্ধান্ত নেয়। মনমোহন সেই মত মেনে নেন। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা আজ বলেন, “নাটকীয় ভাবে সাংবাদিক বৈঠকে হাজির হওয়ার বদলে রাহুল যদি শুধু প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে নিজের মত প্রকাশ করে দিতেন, তা হলে তাঁর উদ্দেশ্যও সফল হত, আর সরকারকেও অস্বস্তিতে পড়তে হত না। এখন যা হল, তাতে সরকারের মুখ পুড়ল। লালুও বাঁচলেন না!”

রায় বনাম অর্ডিন্যান্স
৩০ জুলাই: ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলেই সাংসদ-বিধায়ক পদ খারিজ, রায় সুপ্রিম কোর্টের।
২৪ সেপ্টেম্বর: অর্ডিন্যান্সে সায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পদ বাতিল হবে না।
২৫ সেপ্টেম্বর: বিজেপি ও বামেদের আপত্তি।
২৬ সেপ্টেম্বর: রাষ্ট্রপতিকে অর্ডিন্যান্সে সই না করার আর্জি বিজেপি-র।
২৬ সেপ্টেম্বর: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকে ডেকে ব্যাখ্যা চাইলেন রাষ্ট্রপতি।
২৭ সেপ্টেম্বর: ‘একেবারে ফালতু’, ‘ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলা উচিত’ অর্ডিন্যান্স, বললেন রাহুল। বিদেশে বিব্রত প্রধানমন্ত্রী।
২৭ সেপ্টেম্বর: রাহুল চিঠি লিখেছেন। মন্ত্রিসভায় কথা হবে। বিবৃতি প্রধানমন্ত্রীর।
১ অক্টোবর: কারও কথার উপর তো নিয়ন্ত্রণ নেই, উষ্মা মনমোহনের। জানালেন, দল-সরকারের সম্মতিতেই অর্ডিন্যান্স।
সরকারের অস্বস্তি চাপা দিতেই আজ দিনভর মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছেন কংগ্রেসের ম্যানেজাররা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে শরিকদের সমালোচনা লঘু করে দেখাতে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী মণীশ তিওয়ারি বলেন, “সর্বসম্মতি ক্রমে অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। জোর দিয়ে বলছি, সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।” কিন্তু এক জনের কথায় রাতারাতি মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বদল নিয়েও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। মণীশের জবাব, “কংগ্রেসের সহ-সভাপতি সম্ভবত সমাজের বড় অংশের মতটাই প্রকাশ করেছেন। গণতন্ত্রে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে জনমানসে ক্ষোভ তৈরি হলে সংবেদনশীল সরকার তা পুনর্বিবেচনা করতেই পারে। এতেই প্রমাণ আমাদের সরকার স্বৈরতান্ত্রিক নয়।”
অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহারের যাবতীয় কৃতিত্ব কংগ্রেস নেওয়ার চেষ্টা করলেও জমি ছাড়তে নারাজ বিরোধীরা। গোড়ায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা করলেও অর্ডিন্যান্স নিয়ে আপত্তি তুলেছিল তারা। সেই আপত্তি মূলধন করেই তারা দাবি করছে, অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহারের কৃতিত্ব তাদেরই। পাশাপাশি, রাহুল যে ভাবে মনমোহন সরকারকে অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহারে বাধ্য করিয়েছেন, তা নিয়েও কটাক্ষ করছে বিজেপি-সিপিএম। বিজেপি নেতা অরুণ জেটলির মন্তব্য, “প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখতে হবে এবং নিজের পদ ছেড়ে দেওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত যদি তাঁর অর্ধেক বয়সী কেউ খারিজ করে দেয়, তা হলে তিনি নিশ্চিত ভাবেই কঠিন আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ারও ক্ষমতা রাখেন না।” জেটলির মতে, সাংবিধানিকতা বা নীতিগত কারণে মোটেই অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করা হয়নি। প্রত্যাহার করা হয়েছে পারিবারিক শাসন সাংবিধানিকতার থেকে বড় হয়ে উঠেছে বলে।
কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, গোটা ঘটনায় ইউপিএ সরকার ও দল দু’টি শিক্ষা নিয়েছে। রাহুল ব্রিগেড বুঝতে পেরেছে, মনমোহনের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে রাহুলকে যাবতীয় কৃতিত্ব দেওয়ার চেষ্টাটা ঘোরতর ভুলকাজ হয়েছে। আর সরকার বুঝতে পেরেছে, রাষ্ট্রপতিকে সিলমোহরধরে নিয়ে অবজ্ঞা করে এগোনো যাবে না। দুই শিবিরের এই বোধোদয়ই একমাত্র প্রাপ্তি বলে মনে করছেন কংগ্রেস নেতারা।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.