পিছন থেকে এক ধাক্কা। তাতে প্রায় হোঁচট খেয়েই মেট্রোর কামরায় ঢুকে পড়লেন মধ্য চল্লিশের প্রৌঢ়। অন্য সময়ে হলে তুমুল ঝগড়া বাধার কথা। সেখানে ঘটল ঠিক উল্টো। দু’হাতে জামাকাপড় ঠাসা ব্যাগ, পিছনের মহিলার মুখে ‘সরি’ এবং মিষ্টি হাসি। একগাল হেসে প্রৌঢ়ও বলে ফেললেন, ‘‘আরে, ঠিক আছে। যা ভিড়, হতেই পারে!”
ছুটির দিনে ভরদুপুরের মেট্রো দিব্যি টেক্কা দিচ্ছে অফিসটাইমকেও। গাদাগাদি লোক, হাতে হাতে মোটাসোটা ব্যাগ। কেউ বা ছেলেমেয়েদের হাত ধরে বাজার-অভিযানে। তবু দমবন্ধ ভিড়ে কারওই বিরক্তি নেই তেমন। কারণ? পুজোর আমেজের ঢাকে কাঠি যে পড়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। তার পরেই হইহই করে আনন্দে মাতার পালা। কলকাতা জুড়ে তাই জাঁকিয়ে বসেছে খুশিয়াল মেজাজ।
বস্তুত, পুজোর আগে যে শুধু শহরের চেহারাটাই বদলে যায়, তা নয়। বদলে যায় নাগরিক মানসিকতাও। বছরের ১১ মাস রাস্তার হকার, মেট্রোর ভিড়, যানজট কিংবা রাস্তার ধারে ব্যানার-হোর্ডিংয়ের দৃশ্যদূষণ নিয়ে যাঁরা সরব, এই একটা মাস তাঁরাও এগুলো নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান না। বরং কেউ কেউ বলছেন, রাস্তার হকার কিংবা ব্যানার-হোর্ডিং ছাড়া পুজোর মেজাজটাই ঠিক জমে না।
বিষয়টা যে কেবল কথার কথা নয়, তা অবশ্য চোখে পড়বে হাতিবাগান কিংবা গড়িয়াহাটে গেলেই। কার্যত ১৫ অগস্ট পার হতেই রাস্তায় দোকান সাজিয়ে বসে পড়েছেন বিক্রেতারা। আর দলে দলে ক্রেতার ভিড়ে ফুটপাথ তো বটেই, রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়াও আটকে পড়ে। “কিন্তু এটাই যেন পুজোর চেনা ছবি,” বলছেন উত্তর কলকাতার এক প্রবীণ। গড়িয়াহাটের ছবিটাও আলাদা নয়। নিত্যদিনের ভিড় পুজোর আগে এই সময়ে জনস্রোতের আকার নেয়। “ফুটপাথের এই ভিড় ছাড়া পুজোর বাজারটাই ঠিক জমে ওঠে না,” মন্তব্য গৃহবধূ কল্পনা দাসের। |
ঠিক যেমন পুজোর আমেজটাও আসে না রাস্তার ধারে ব্যানার-হোর্ডিং না দেখলে। বছর কয়েক ধরে অবশ্য নববর্ষ পেরোতে না পেরোতেই রাস্তার ধারে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে বড় ক্লাবগুলো। ছোট পুজোর কর্তারা অবশ্য মাঠে নামেন স্বাধীনতা দিবসের পরেই। ধীরে ধীরে রাস্তার ধার পুরোটাই ছেয়ে যায় পুজোর বিজ্ঞাপনে। এমনকী, ট্রামলাইনেও বসে যায় হোর্ডিং। আর এই বিজ্ঞাপনের হাত ধরেই উত্তর মিশে যায় দক্ষিণে, বেহালার পুজোর খবর পায় বেলেঘাটাও!
তবে এ সবের বাইরেও শহরের বাসিন্দারা মানিয়ে নেন যানজট কিংবা মেট্রোয় গাদাগাদি ভিড়ের মতো আরও বেশ কিছু সমস্যা। পুলিশ সূত্রের খবর, শহরের বেশ কিছু পুজো হয় রাস্তার উপরে। উৎসবের আবেগের কথা মাথায় রেখেই এই পুজোগুলির অনুমতি দেওয়া হয়। এই পুজোগুলির কারণে কিছু ক্ষেত্রে যান চলাচলেও সমস্যা তৈরি হয়। কিন্তু শহরের বাসিন্দাদের অনেকেই এই সমস্যার বিরুদ্ধে মুখ খোলার বিরোধী। তাঁদের কথায়, “চারটে মাত্র দিন। একটু সমস্যা মানিয়ে নিয়ে যদি পুজোর আনন্দ বাড়িয়ে তোলা যায়, অসুবিধা কোথায়?” ঘটনাচক্রে, এ বছর পুজো কমিটি এবং পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় বৈঠকেও একই কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, চার দিনের পুজোর অনুমতি দিতে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে।
আর পুজোর আগের এক মাস কলকাতা যে হকার, ব্যানার-হোর্ডিংয়েরও?
মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “উৎসবের আমেজ ও সাধারণ মানুষের জন্যই হকার ও হোর্ডিং সংক্রান্ত ছাড় দেওয়া হয়।” মানছেন লালবাজারের কর্তারাও। এক কর্তার বক্তব্য, “উৎসব ঘিরে মানুষের আবেগ মাথায় রেখেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নাগরিকেরাও এতে বিশেষ আপত্তি করেন না।”
কিন্তু বছরভর যে সমস্যাগুলো নিয়ে গলা ফাটান মানুষ, মেট্রোর ভিড় কিংবা ফুটপাথ জোড়া হকার দেখে ভুরু কোঁচকায় বিরক্তিতে, এই একটা মাস সেই সমস্যাগুলোকেই দিব্যি মানিয়ে গুছিয়ে নেন কী করে?
মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, পুজোর আমেজেই যাবতীয় সমস্যাকে মানিয়ে নেয় বাঙালি। এক দিকে ফুরফুরে মেজাজ আর অন্য দিকে মন ভাল করা আবহাওয়া, দুয়ে মিলেই এই মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয়। তাঁর কথায়, “একেবারে ছোটবেলা থেকেই বাঙালি পুজোর আমেজ ব্যাপারটার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যায়। নতুন জিনিসপত্র কেনা, উপহার দেওয়া-নেওয়া, বেড়াতে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া মিলিয়ে অন্যের ভাল চাওয়ার বোধ, পারস্পরিক সৌহার্দ্য সামনে এসে দাঁড়ায়। যে মনটা কাজের চাপে সারা বছর চাপা পড়ে থাকে, এ সবের ফুরসত মেলে না। ফলে এই সময়টায় সবাই ভাল থাক, এই ইতিবাচক মানসিকতাটাই কাজ করে। এ ছাড়া আছে প্রকৃতির প্রভাব। ঝকঝকে নীল আকাশ, সোনালি রোদে মনটাও ফুরফুরে হয়ে থাকে। সেটাই মনকে প্রসারিত করে।”
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অবশ্য সাধারণ মানুষের অসুবিধার দিকটা উড়িয়ে দেননি। তাঁর কথায়, “ফুটপাথ জোড়া হকারে, ভিড়ে বা হোর্ডিংয়ের দৃশ্যদূষণে মানুষের যে সমস্যা হয় না তা নয়। কেউ কেউ বিরক্তও হন। তবে পুজোর আনন্দে এই সময়টায় মন ভাল থাকে বলেই হয়তো মানুষ সে সব মেনেও নেন।” |