শিক্ষায়, চাকরিতে সংরক্ষণ চলে। চলছেও। কিন্তু আতুরের শুশ্রূষায়, পীড়িতের রোগ নিরাময়ে কি আদৌ সম্প্রদায় বিভাজন করা যায়?
শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল তুমুল। অথচ সেই ভিন্নমতকে আমল না-দিয়ে শুধু বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের জন্য স্বাস্থ্য প্রকল্পের শিলান্যাস করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিছু হটতেই হল রাজ্য সরকারকে। মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই) বাদ সাধায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এখন বুঝতে পেরেছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ে শুধু সংখ্যালঘুদের জন্য মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল তৈরি করা যাবে না। তারা ঠিক করেছে, সংখ্যালঘুদের জন্য সেখানে আসন ও শয্যা সংরক্ষণের ব্যবস্থা হবে। |
ভাঙড়ের নলমুড়িতে এই জমিতেই শুধু সংখ্যালঘুদের জন্য মেডিক্যাল
কলেজ ও হাসপাতাল তৈরি হওয়ার কথা ছিল। —ফাইল চিত্র। |
মহাকরণের খবর, সংখ্যালঘুদের জন্য মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা ছিল মুখ্যমন্ত্রীরই। তিনিই আবার রাজ্যের স্বাস্থ্য ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী। ভাঙড়ে ওই প্রকল্পের ভাবনার পিছনে যুক্তি দেখানো হচ্ছিল, ওখানকার বিস্তীর্ণ এলাকা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। মমতার ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে কোমর বাঁধছিল সংখ্যালঘু উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য দফতর। প্রকল্পটির জন্য মাত্র এক টাকার বিনিময়ে ওই দফতরকে ২২ একর জমি দেয় কলকাতা পুরসভা। ঠিক হয়, ওই মেডিক্যাল কলেজে ১০০টি আসন থাকবে এবং সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল হবে ৫০০ শয্যার। গত বছর ২১ অগস্ট সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের তৎকালীন সচিব বিক্রম সেন একটি চিঠি দেন পূর্ত বিভাগের তদানীন্তন চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে। তাতে তিনি লেখেন, মুখ্যমন্ত্রী মূলত সংখ্যালঘুদের জন্য ভাঙড়ে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল চাইছেন। সেই প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি করতে হবে।
সেই অনুযায়ী গত ১১ ফেব্রুয়ারি ভাঙড়ের দু’নম্বর ব্লকের নলমুড়িতে হাসপাতালের শিলান্যাসও করেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু শুধু সংখ্যালঘুদের জন্য মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল গড়ার নীতি কী ভাবে তৈরি করা যাবে, ভেবে পাননি সংশ্লিষ্ট দফতরের অফিসারেরা। ফলে প্রকল্পের রূপরেখা তৈরির কাজ থমকে যায়। এরই মধ্যে এমসিআই তাদের মতামত জানিয়ে দেওয়ায় এখন আগের ভাবনা থেকে সরে এসেছে সরকার।
কী বলেছে এমসিআই?
সরকারি সূত্রের খবর, মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতাল অনুমোদনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমসিআই জানিয়ে দিয়েছে, ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশে শুধু একটি সম্প্রদায়ের জন্য কোনও মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতাল তৈরি করা যায় না। এমসিআইয়ের আইন সেলের সদ্য প্রাক্তন সদস্য অরুণ বলের কথায়, “আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের ১৭-১৮টি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কোনওটিতেই শুধু সংখ্যালঘুদের চিকিৎসা হয় না। এটা অবাস্তব। সংখ্যালঘুদের জন্য শুধু আসন বা শয্যা সংরক্ষণ করা যায়, সেটাই বলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গকে।”
এমসিআইয়ের বক্তব্য জানার পরেই নড়েচড়ে বসেছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা। তাঁদের দাবি, এমসিআই এখন যা বলেছে, তাঁরা গোড়া থেকেই সে-কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু এত দিন সেটা কেউ কানেই তোলেননি।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, এমসিআইয়ের অভিমত জানার পরেই গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে বৈঠক হয় স্বাস্থ্য ভবনে। সেখানে স্বাস্থ্য ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের অফিসারেরা ছিলেন। ছিলেন স্বাস্থ্য দফতরের ‘সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) সেলের কর্তারাও। সেলের উপদেষ্টা গৌতম মজুমদার জানান, ওই প্রকল্পের একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল গড়া হবে পিপিপি মডেলে। এই ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের সঙ্গে চুক্তি হবে আগ্রহী বেসরকারি সংস্থার।
কী আছে প্রকল্পের খসড়ায়?
গৌতমবাবু জানান, খসড়ায় বলা হয়েছে, আগ্রহী বেসরকারি সংস্থা মেডিক্যাল কলেজের ৩৩% আসন সরকারকে দেবে। তার একটি অংশ সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। একই ভাবে হাসপাতালের ২৫% শয্যা থাকবে গরিব রোগীদের জন্য। তারও একটি অংশ থাকবে সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত। “এটা আইনসম্মত কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য খসড়াটি আইন সেলে পাঠানো হয়েছে,” বললেন গৌতমবাবু।
স্বাস্থ্য দফতরের খবর, এই প্রকল্পে অংশীদার হওয়ার জন্য দক্ষিণ ভারতের একটি সংখ্যালঘু ট্রাস্টের সঙ্গে কথা চলছে। ট্রাস্ট থাকলে আসন বা শয্যা সংরক্ষণে সুবিধা মেলে। কিছু সরকারি অফিসারের বক্তব্য, সরকারি চাকরি বা প্রকল্পে সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষণ নতুন নয়। রাজ্যে ওবিসি-দের জন্য যে-সংরক্ষণ চালু আছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও তার অন্তর্গত। কিন্তু আস্ত একটি মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতাল শুধু একটি সম্প্রদায়ের জন্য চিহ্নিত হতে পারে না।
রাজ্যের বোধোদয়ে দেরি হওয়ায় প্রকল্পটিও পিছিয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “এমসিআইয়ের নির্দেশ না-মানলে যে মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অনুমোদন মিলবে না, সেটা বুঝতে পেরেই নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসছে রাজ্য। অথচ এই সিদ্ধান্ত গোড়ায় নিলে এত দিনে হয়তো নির্মাণকাজ শুরু হয়ে যেত।”
|