প্রকাশ্যে সকলেরই এক কথা। এ রাজ্যে তারা কারও সঙ্গে জোটে নেই। তবু তার মধ্যেই আসলে স্পষ্ট লোকসভা ভোটের আগে সম্ভাব্য সমীকরণের প্রশ্নে সব দলের দোদুল্যমানতা। মুখে এই মুহূর্তের পরিস্থিতির কথা বললেও অদূর ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনার কোনও দরজা বন্ধ করছে না কেউই।
কংগ্রেস, বিজেপি এবং তৃণমূল মঙ্গলবার এই তিন দলের নেতৃত্বই ফের জানিয়েছেন, তাঁরা আপাতত কেউ জোটে নেই। কলকাতায় এসে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী তথা কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ তৃণমূলকে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গেই এক বন্ধনীতে বসিয়েছেন। তৃণমূলও তার জবাবে ফের বলেছে, কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের জোট করার প্রয়োজন নেই। আবার একই দিনে এই শহরেই বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি রাজনাথ সিংহ বলেছেন, তাঁর দল তৃণমূলের সঙ্গে কোনও গোপন আঁতাঁতে নেই। |
কলকাতায় জয়রাম রমেশ।—নিজস্ব চিত্র। |
এখনও পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, তাতে আগামী লোকসভা ভোটে কংগ্রেস, তৃণমূল ও বিজেপি তিন দলের আলাদা ভাবে লড়াই করার সম্ভাবনাই বেশি। একই সঙ্গে আবার এ-ও ঘটনা যে, কংগ্রেস এবং বিজেপি, এই দুই সর্বভারতীয় দলই নানা রাজ্যে সম্ভাব্য মিত্র সন্ধানে রয়েছে। এই তত্পরতার মধ্যেই নতুন মাত্রা যোগ করেছে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর নাম ঘোষণার পরে দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। মোদী-হাওয়া ঠেকাতে অ-বিজেপি সব দলই এখন উদ্বিগ্ন। এবং সেই বাস্তবতার মধ্যেই আপাত-অদেখা কিছু সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। মোদীকে আটকানোর স্বার্থেই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের হাত ধরার যুক্তি থেকে যাচ্ছে কংগ্রেসের পক্ষে। তেমন হলে পুরোদস্তুর জোটের বদলে কিছু আসনভিত্তিক সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়েও ভাবনাচিন্তা জারি আছে।
প্রকাশ্যে কেউই অবশ্য এখন সেই সম্ভাবনার কথা বলছেন না। রাজ্যে সাম্প্রতিক সব ভোটের ফল দেখিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব দাবি করছেন, একাই সাফল্যের পথে তাঁদের কোনও বাধা নেই। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বও একই ভাবে জোটের পক্ষে সওয়াল করছেন না। তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নে জয়রাম যেমন এ দিনই বলেছেন, “বিজেপি, আরএসএসের সঙ্গে যোগ না দেওয়ার মতো কোনও সঙ্কেত এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেননি!” বরং, হাওড়া লোকসভা উপনির্বাচনের প্রসঙ্গ এনে তৃণমূলকে যথেষ্ট খোঁচাই দিয়েছেন জয়রাম। তাঁর মন্তব্য, “গোপনে সমঝোতা করে বিজেপি-র প্রার্থী প্রত্যাহার করিয়ে যে দল (তৃণমূল) লোকসভার উপনির্বাচনে জিততে পারে, তাদের সঙ্গে জোট করার প্রশ্নই ওঠে না!”
এর প্রেক্ষিতে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় পাল্টা বলেছেন, “আমরা কি জোট করতে চেয়েছি? আগেই বলেছি, মানুষের সঙ্গে একলা আছি, ভাল আছি!” বিজেপি-র সঙ্গে তাদের গোপন আঁতাতের প্রশ্নে মুকুলবাবুর প্রতিক্রিয়া, “পরপর ভোটে বিজেপি-কংগ্রেসকে হারিয়েই জিতলাম। কংগ্রেস বা বিজেপি কারও সঙ্গেই আমরা নেই!” জয়রামের বক্তব্যের জবাবে বিজেপি-র সভাপতি রাজনাথও কলকাতায় বলেছেন, “গোপন আঁতাঁত কংগ্রেস করে! বিজেপি করে না। আমরা যা-ই করি, খোলাখুলি করি!” কয়েক মাস আগে হাওড়ার উপনির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি বিজেপি। ভোট-ময়দান থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য রাজনাথের কাছে তৃণমূল দরবার করেছিল বলে দিল্লির রাজনৈতিক শিবিরের খবর। সেই সূত্রেই জয়রাম তৃণমূলকে সাম্প্রদায়িক শক্তি বলতে দ্বিধা করেননি। তাঁর কথায়, “আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত থাকলেই সাম্প্রদায়িক হয় না। গোপনে যে বিজেপি-র সঙ্গে বোঝাপড়া করে, সে-ও সাম্প্রদায়িক শক্তি!”
রাজনাথ অবশ্য মমতার সঙ্গে জোট-সম্ভাবনা কৌশলে এড়িয়েই গিয়েছেন। ফের বলেছেন, “ও রকম কোনও প্রস্তাব আমরা পাইনি। প্রস্তাব পেলে তবে তো!” বিজেপি কি মমতাকে জোটের প্রস্তাব দেবে? রাজনাথের বক্তব্য, “আমাদের দিক থেকে এ রকম কোনও প্রস্তাব নেই।” মমতা সোমবারই বলেছেন, বিজেপি যতই ঘেউঘেউ করুক, তাতে তাদের কোনও লাভ হবে না! এ বিষয়ে রাজনাথ অবশ্য পাল্টা মন্তব্যে যাননি।
জয়রাম আবার কৌশলে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সর্বভারতীয় রাজনীতির নিরিখে তাঁরা তৃণমূলকে নিয়ে বিশেষ ভাবিত নন! তিনি বলেছেন, “৭-৮টি রাজ্যে বিজেপি রয়েছে। বাকি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, কেরলে সিপিএম আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী।” তৃণমূলকে আঞ্চলিক দল বলেই উল্লেখ করেছেন জয়রাম।
প্রকাশ্যে এ সব বিবৃতির আড়ালেই তবু ঘুরপাক খাচ্ছে ভবিষ্যতের নানা সমীকরণ! |