যথাযথ পরিবেশ ও পরিকাঠামো মিললে পশ্চিমবঙ্গে লগ্নি করতে আপত্তি নেই মুম্বই সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এমনই বার্তা দিয়েছিল দেশের শিল্প-বণিকমহল। তার পর থেকেই সংস্কারমুখী হয়েছেন মমতা। সরকারি সূত্রের ইঙ্গিত, গ্রামবাংলার সমর্থনে আত্মবিশ্বাসী মমতা এখন মুম্বই-পরবর্তী সংস্কার কর্মসূচিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এবং উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে ‘প্রয়োজনভিত্তিক’ জমি অধিগ্রহণে মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতিকে তারই অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন প্রশাসনের অন্য কর্তারা।
মহাকরণের খবর, মমতা সম্প্রতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা ভূমি মন্ত্রী হিসেবে অফিসারদের জানিয়ে দিয়েছেন, রাস্তা, সেতু-সহ পরিকাঠামো উন্নয়নের নানাবিধ কাজে জমি লাগলে অধিগ্রহণ করতে হবে। তবে তা করতে হবে জমি-মালিককে বুঝিয়ে, উপযুক্ত দাম দিয়ে। উন্নয়ন প্রকল্পে প্রয়োজনভিত্তিক জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি দেখে প্রশাসনিক মহল ঘোরতর আশাবাদী। কর্তাদের দাবি, ভাবনায় সামান্য এই বদলই রাজ্যে স্রেফ রাস্তাঘাট-সেতু ইত্যাদি নির্মাণে অন্তত সাড়ে ছ’হাজার কোটি টাকার লগ্নি-সম্ভাবনা তৈরি করেছে। যার সুবাদে আসতে পারে আরও বিনিয়োগ।
মহাকরণ-সূত্রের বক্তব্য, মমতা এখনও নীতিগত ভাবে বলপূর্বক জমি অধিগ্রহণের তীব্র বিরোধী। তবে তিনি এ-ও বুঝেছেন, রাজ্যে বিনিয়োগ টানতে হলে পরিকাঠামোয় উন্নয়ন ঘটানো জরুরি। কলকাতার দূরের জেলায় শিল্প গড়তে হলে জল-বিদ্যুত্-রাস্তার ব্যবস্থা করতেই হবে। বস্তুত এ রাজ্যে শিল্পের অভাবেই বিদ্যুত্ এখন উদ্বৃত্ত, জলেরও অভাব নেই। কিন্তু রাস্তাঘাটের হাল বেশ খারাপ। তাই মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের মধ্যে দিয়ে যাওয়া বিভিন্ন জাতীয় সড়কের উন্নয়ন-সম্প্রসারণে উদ্যোগী হয়েছেন। সেই সূত্রেই তিনি অফিসারদের বলেছেন, চাষি বা জমি-মালিকদের রাজি করিয়ে অধিগ্রহণ করা গেলে করতে হবে। “মুখ্যমন্ত্রী উপলব্ধি করেছেন, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে প্রয়োজনভিত্তিক জমি অধিগ্রহণ সম্ভব হলে বহু বছর ধরে আটকে থাকা বহু প্রকল্পের জট খুলে যাবে।” মন্তব্য এক কর্তার।
শীর্ষ নেত্রীর সবুজ সঙ্কেত পেয়ে প্রশাসনও কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এক সিদ্ধান্তেই গতি পেয়েছে জাতীয় সড়ক উন্নয়ন-সম্প্রসারণের কাজ। |
গতির পথে |
|
সম্প্রসারণ প্রকল্প* |
বরাদ্দ** |
বারাসত-ডালখোলা (৩৪) |
৪২০০ |
পানাগড়-বরাকর (২) |
১৬০০ |
খড়্গপুর-রানিগঞ্জ (৬০) |
৬০ |
শিলিগুড়ি-আলিপুরদুয়ার (৩১) |
৯৫ |
ফুলহার সেতু (বিহার-বাংলা) |
২৫০ |
হাতানিয়া-দোয়ানিয়া সেতু |
২০০ |
* জাতীয় সড়ক, (বন্ধনীতে সড়ক নম্বর বা অন্য বিবরণ)
**কোটি টাকায় |
|
কী রকম?
এক সরকারি মুখপাত্রের দাবি, গত ৩০ সেপ্টেম্বর জাতীয় সড়কের জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন রাস্তার জন্য জমি অধিগ্রহণের ছক কষে ফেলা হয়েছে। রাজ্যের ভূমি-সচিব অমরেন্দ্রকুমার সিংহ ও জাতীয় সড়ক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএইচএআই)-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান অজয় অহলুওয়ালিয়ার উপস্থিতিতে আয়োজিত ওই বৈঠকে স্থির হয়েছে, রেললাইনের সমান্তরাল কোনও জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের স্বার্থে জমি নিতে হলে রেলের হারে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কারণ, দেশের জমি অধিগ্রহণ আইনগুলোর মধ্যে রেলের আইনেই রয়েছে জমিদাতাদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্যাকেজ, যা তৈরি হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন।
মমতার হাতে তৈরি সেই রেল-মডেলেই রেললাইন বরাবর জাতীয় সড়কের জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপদেষ্টা কমিটি। এ দিকে বিহারে এখন জমি অধিগ্রহণের সময় দাম দেওয়া হয় বাজারদরের ১.৯ গুণ। এ রাজ্যে যা ১.৩ থেকে ১.৪৫ গুণ। তাই ঠিক হয়েছে, যেখানে রেল লাইন নেই, সেখানে বিহারের ধাঁচে বাজারদরের প্রায় দ্বিগুণ অর্থ জমি-মালিকদের দেওয়া হবে। কমিটির এক সদস্যের কথায়, “জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণের জমি নেওয়া হয় জাতীয় সড়ক উন্নয়ন আইনেই। এই আইনে জমিদাতাদের জন্য যে প্যাকেজ, তা রাজ্যের আইনের চেয়ে ভাল। তার পরেও কেউ জমি দিতে না-চাইলে তাঁদের বোঝানো হবে।’’
তবে রাজ্য সরকার যে জমি নিতে রাজি হয়েছে, এটাই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় পরিবর্তন বলে মন্তব্য করেছেন ওই সদস্য। ভূমি-কর্তারা জানাচ্ছেন, ২০১১-য় রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পরে মুখ্যমন্ত্রী জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ফাইল দেখতেনই না। তিনি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, সরকার কোনও জমি অধিগ্রহণ করবে না। ফলে একটা সময় অধিগ্রহণ সংক্রান্ত প্রায় আড়াইশো ফাইল মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে জমে গিয়েছিল। সেই অবস্থা এখন আর নেই। মন্ত্রিসভার অনুমোদনসাপেক্ষে সামান্য পরিমাণ জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া বছরখানেক আগেই শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এখনও কোনও বড় প্রকল্পে জমি নেওয়ার ছাড়পত্র না-দিলেও জাতীয় সড়কের জট ছাড়াতে তাঁর এই পদক্ষেপকে ‘বৈপ্লবিক’ হিসেবে দেখছেন মহাকরণের কর্তাব্যক্তিরা।
পূর্তমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার অবশ্য ঘটনাটিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘নীতি বদল’ বলতে নারাজ। “আমাদের জমি-নীতির কোনও বদল হয়নি। আমরা জবরদস্তি জমি নেব না। চাষিরা উপযুক্ত দাম নিয়ে জমি দিলে অধিগ্রহণ হতে পারে। জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণেও এই নীতি অনুসরণ করা হবে।” মঙ্গলবার মহাকরণে বলেন পূর্তমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “এখন সরকারের নীতি হল, জমি হাতে আসার পরে কাজে নামা। এতে বোঝা যাচ্ছে, জমির ব্যবস্থা করতে সরকার বরাবরই সক্রিয়। তবে কোথাও বাধা এলে সেখানে হাত দেওয়া হবে না। রাস্তাও চওড়া হবে না।”
এ বার মমতার সংস্কার-নীতির প্রভাব কতটা পড়বে এ রাজ্যে জাতীয় সড়কের উন্নয়নযজ্ঞে?
এনএইচএআইয়ের এক কর্তার ব্যাখ্যা: ২০০৯-এ ৪১৪ কিমি লম্বা ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণে নামা হয়েছিল, ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪২০০ কোটি। জমি-জটে গত চার বছরে কাজ তেমন এগোয়নি। বহরমপুর-ফরাক্কা অংশে ৬৪%, ফরাক্কা-রায়গঞ্জে ৫২% ও কৃষ্ণনগর-বহরমপুরে ৩০% কাজ হয়েছে। জমি না-মেলায় বারাসত-কৃষ্ণনগর ও রায়গঞ্জ-ডালখোলায় কাজ বলতে গেলে হয়ইনি। তবে গত জুলাই ইস্তক জমি নেওয়ার চেষ্টা শুরু হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নের আশা দেখা দিয়েছে। কর্তারা জানিয়েছেন, ফুলহার ও হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদীর উপরে দু’টি সেতু-সহ আরও কয়েকটি সড়ক প্রকল্পও এ বার জোরকদমে শুরু হবে। পাশাপাশি সরকার জমি অধিগ্রহণে রাজি হওয়ায় এনএইচএআই-ও এ বার ২ নম্বর জাতীয় সড়কে পানাগড়-বরাকর অংশ বাড়িয়ে ছ’লেন করতে চলেছে। এতে লাগবে ১৬০০ কোটি টাকা। ফলে পানাগড়ে নিত্য যানজটের যন্ত্রণামুক্তির ইঙ্গিতও পেতে শুরু করেছেন সরকারি মহল। |