সাবেকি রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি ছেড়ে এ বার আধুনিক কবিতার যাদুতে মজেছে বিষ্ণুপুরের শাড়ি।
কয়েক বছর ধরে এই কাজ করে চলেছেন বিষ্ণুপুরের বালুচরী শিল্পী অমিতাভ পাল। স্বীকৃতিও পেয়েছেন। রাজ্য সরকার গত বছর তাঁর বোনা ‘রূপশালী’ শাড়িটিকে ‘শ্রেষ্ঠ শাড়ি’র সম্মান দেয়। বিষ্ণুপুরেরই এক বিখ্যাত কবির কবিতা অবলম্বনে ওই শাড়ি তৈরি করেছিলেন অমিতাভ। শাড়ির উপরে সেই কবিতার চরিত্র তুলে ধরেছিলেন তিনি। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বইয়ের বাজার ছুঁয়ে সেই শাড়ি পাড়ি দেয় দুবাইয়েও।
এ বারও সোনালি সুতোর শাড়ির নকশায় ধরা পড়েছে এক কবির ‘আদিবাসী গ্রামের মাদল’ কাব্যগ্রন্থের ছায়া। যাতে ধরা পড়েছে বাংলা, ওড়িশা ও ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী ‘তিন কন্যা’র উপাখ্যান। বিষ্ণুপুরের গড়্গড়ান এলাকায় নিজের তাঁতশালে বসে অমিতাভ বলেন, “পুরাণকথা ছেড়ে বছর পাঁচেক আগে আদিবাসী চিত্রকলায় মজে ছিলাম আমি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বালুচরীতে মুগা ও কটকির ব্যবহার করে নতুনত্ব নিয়ে আসি। গত বছর থেকে আধুনিক কবিতা চেপে বসেছে মাথায়। রূপশালী বালুচরী বাজারে ছেড়ে গতবার পুজোয় ব্যাপক সাফল্য পাই। ওই শাড়ি বুনে রাজ্য স্তরে অনেকগুলি পুরস্কার পাই।” এ বারও তাই নকশায় বৈশিষ্ট্য আনতে কবিতার দিকেই হাত বাড়িয়েছেন তিনি। লাগোয়া তিন রাজ্যের আদিবাসী তিন কন্যাকেই এ বার শাড়িতে চিত্রিত করেছেন অমিতাভ। |
সৃষ্টির সঙ্গে শিল্পী।—নিজস্ব চিত্র। |
কেমন সেই শাড়ি?
শিল্পীর কথায়, “আমার শাড়িতে এসেছে নানা ভঙ্গিমায় আদিবাসী গ্রামে মাদলের দ্রিমি-দ্রিমি সুরে কেউ নৃত্যরত, কারও হাতে খোল ও শিঙা। আশা করছি ভিন্ন ধারার এই শাড়ি মহিলা মহলে সমাদৃত হবে।” এ শাড়ির আরও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অমিতাভ জানান, শাড়িটি তিন রঙা। তার উপরে থাকছে রেশম ও জরির কাজ। কুঁচির কাজও অন্য রকম। আঁচল ও পাড়ে থাকছে তিন কন্যার ছবি। ইতিমধ্যে অসম সরকারের বস্ত্র বিভাগের তরফে এই শাড়ি কিনতে চেয়ে বায়না এসেছে। কলকাতা ও মুম্বইয়ের কিছু দোকানেও কয়েক দফায় কিছু শাড়ি পাঠিয়েছেন তিনি।
পুজোর এই শেষ বেলায় বাজার ধরতে অমিতাভর তাঁতশালে এখন চূড়ান্ত ব্যস্ততা। তাঁর সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন মা কাঞ্চন দেবী, দাদা সুধীন, বোন সরযূ এবং কর্মচারী ধনঞ্জয় নন্দী। ব্যস্ততার ফাঁকেই অমিতাভ বলেন, “৯০০ গ্রাম ওজনের এই শাড়িতে সুতো ও জরি ৪০০ গ্রাম করে রয়েছে। বাকিটা মিনা।”
বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত শাড়িটিকে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাই এই বালুচরী শিল্পীর নেশা। সেই সূত্রেই বছর পাঁচেক আগে রাজ্যের তৎকালীন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায় তাঁকে ‘শ্রেষ্ঠ শাড়ির’ সম্মান দেন। অমিতাভ বলেন, “ওই সম্মান পাওয়ার পরেই প্রতি বছর পুজোয় নতুন কিছু করার আর সেই সৃষ্টিকে নিয়ে দেশময় ছুটে বেড়ানো আমার নেশা হয়ে উঠেছে।”
যাঁরা বলেন, তাঁতের শাড়ির সুদিন গিয়েছে। তাঁদের কাছে যেন নজির এই বছর তিরিশের যুবকটি। এখন তিনি শাড়ি তৈরি করে বিপণন করতে নিজেই কলকাতা থেকে মুম্বই, দিল্লি থেকে চেন্নাই দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী শাড়িতে মুগ্ধ দক্ষিণীরাও। কেরলের সেন্ট্রাল কটেজ থেকেও তিনি সম্মান পেয়েছেন। তবে এ সবের থেকেও শিল্পীকে মুগ্ধ করে তাঁর তৈরি নতুন শাড়িতে রূপশালী নারীরা প্রিয়জনের চোখে যখন আরও মোহময়ী হয়ে ওঠেন। সেই মুগ্ধতার মোহেই পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন শিল্পী। |