মেঝেতে শতচ্ছিন্ন মলিন কার্পেট। নোনা ধরা দেওয়াল থেকে কবেই চটে গিয়েছে রঙের প্রলেপ। হলঘরের যত্রতত্র ডাঁই করা বস্তা, বড় কৌটো, বালতি, দড়ি-সহ নানা জিনিসপত্র। খোলা দেওয়াল আলমারিতে জমছে ফাইলের স্তূপ। তার উপর ধুলো জমে কালো হয়ে উঠেছে। দেওয়াল জুড়ে এদিক-ওদিক ঝুলছে বিদ্যুতের তার। ভিতরে সারি দিয়ে রাখা সাইকেল। হলেরই দেওয়ালে ঝুলছে ধুলোয় ভরা মহাত্মা গাঁধীর ছবি।
সারা বছর এমনই থাকে পুরুলিয়া পুরসভার ঐতিহ্যবাহী গাঁধী হল। দীর্ঘ সংস্কারের অভাবে শতাব্দী প্রাচীন এই হল ক্রমশ আরও জীর্ণ দশাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কিন্তু সংস্কারের বালাই নেই। অথচ এই হলঘরেই কাউন্সিলরা নিয়মিত বোর্ড-মিটিংয়ে বসেন। তাঁদেরই একজন বলেন, “এ ভাবেই তো বছরের পর বছর হলটি রয়েছে। তবে নজর দেওয়া দরকার।” প্রাক্তন পুরপ্রধান সিপিএমের বিনায়ক ভট্টাচার্যের কথায়, “এই হলে আগে কত গুণী মানুষজন এসেছেন। শুনেছি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, আচার্য কৃপালিনী, মানবেন্দ্রনাথ রায় থেকে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী নিজেও এখানে এসেছিলেন। তাঁর স্মৃতিতেই এই হল তৈরি হয়েছিল ১৮৭৬ সালে। ১৯৭৬ সালে এই হলের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানও হয়েছে।” তাই শতবর্ষ প্রাচীন গাঁধী হলের এই বেহাল দশায় ক্ষুব্ধ পুরবাসী। স্কুল শিক্ষক জগন্নাথ দত্ত বলেন, “পুরুলিয়ায় বঙ্গভুক্তি আন্দোলনের মতো নানা আন্দোলন অতীতে হয়েছে। সে সবের সঙ্গে এই ঐতিহ্যবাহী হলটিরও একটা ভূমিকা ছিল।” পুরুলিয়া শহরের সাংস্কৃতিক কর্মী সৈকত রক্ষিতের মতে, “হলটির ঐতিহ্যের বিষয় গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার করা প্রয়োজন। এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করতে দেওয়া উচিত।” তাঁর সুরেই বিনায়কবাবুর দাবি, এই হল লাগোয়া জুবিলি ময়দানে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় মিছিল, সভা হয়েছে। হলটি সংস্কারের পাশাপাশি এখানে একটি মুক্তমঞ্চও গড়া হোক। তা হলে সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হতে পারবে।” |
আরও এক প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য কৃষ্ণপদ বিশ্বাস জানান, একদা এখানে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড ও পুরসভার যৌথ বৈঠক হত। পুরুলিয়ার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত এই হল। পুরসভায় ক্ষমতা থাকাকালীন তাঁরা করেননি কেন? বিনায়কবাবুর জবাব, “আমরা উদ্যোগী হয়েছিলাম। সংস্কারের পরিকল্পনা ব্যয় ধরা হয়েছিল পাঁচ লক্ষ টাকা। কিন্তু সে বছরই আমরা ক্ষমতা থেকে সরে যাই। তাই আর করা যায়নি।”
পুরসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের বিভাসরঞ্জন দাস বলেন, “এই ঐতিহ্যবাহী হলটি এখন কার্যত গুদামঘর। আমরা বহুবার সংস্কারের দাবি জানিয়েছি। কিছুই হয়নি।” বর্তমান পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায় স্বীকার করেন, এই ঐতিহ্যবাহী হলটির যে সংস্কার করা প্রয়োজন তা নিয়ে দ্বিমত নেই। তিনি বলেন, “আমরা ক্ষমতায় এসেই হলটিকে ‘হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের’ স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য রাজ্য হেরিটেজ কমিশনকে অনুরোধ করেছিলাম। কমিশন থেকে জেলাশাসককের কাছে এ ব্যাপারে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছিল। কিন্তু সেই রিপোর্ট কমিশনে জমা পড়েনি।” এর পরে ফের তাঁর স্বীকারোক্তি, “আমাদের পক্ষ থেকেও নানা কারণে আর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে এ বার জেলাশাসককে নুতন করে উদ্যোগী হতে অনুরোধ জানাব।” |