নতুন পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা কাজ শুরু করেছেন। এই উপলক্ষে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তনের শুরু থেকে গ্রামে বাস করার অভিজ্ঞতা সম্বল করে ক’টি কথা বলার চেষ্টা করব।
এ দেশে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগেই সমস্ত দিক বিচার বিবেচনা এবং পঞ্চায়েতের পরিকাঠামো কী হবে, কী কী ক্ষমতা তাদের দেওয়া হবে ইত্যাদি সকল বিষয় পর্যালোচনার জন্য প্রয়াত অশোক মেটা’র নেতৃত্বে একটি পঞ্চায়েতি রাজ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। অশোক মেটা সেই উপলক্ষে কলকাতা এসেছিলেন। নিমন্ত্রিত হয়ে প্রয়াত পান্নালাল দাশগুপ্ত এবং আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে রাজভবনে গিয়েছিলাম। কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, পঞ্চায়েত এমন একটি অস্ত্র, যার দু’দিকেই সমান ধার আছে। এক দিকে এটি একেবারে গ্রাম স্তরে উন্নয়নের অতি শক্তিশালী এবং সার্থক হাতিয়ার হতে পারে। অন্য দিকে, এটি হয়ে উঠতে পারে উন্নয়ন-বিরোধী বিকেন্দ্রীকৃত একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান, যা গ্রামীণ ব্যবস্থায় যুগ যুগ ধরে চলে আসা ব্যবস্থাগুলিকে শক্তিহীন করে দেবে এবং শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের অঙ্গ এবং রাজনীতির কোলাহলের জায়গায় পরিণত হবে। শুরু থেকেই ঠিক পথে না চালাতে পারলে পঞ্চায়েত প্রকৃত উন্নয়নের হাতিয়ার হয়ে উঠবে না। কথাটা আজও প্রাসঙ্গিক। |
ইংরেজ আমলে কংগ্রেস প্রাদেশিক স্তরে সরকার গঠন করেছিল। তখন গাঁধীজির অনেক শিষ্য প্রদেশে প্রদেশে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাঁরা গাঁধীজিকে গিয়ে বললেন, আপনি তো আমাদের অহিংসা, সত্যাগ্রহ, সত্যনিষ্ঠ হওয়া, এ সব শিখিয়েছেন, কিন্তু মন্ত্রিত্ব কী করে করতে হয়, তা তো শেখাননি। গাঁধীজি উত্তরে বলেছিলেন, ‘মন্ত্রী হিসেবে যখন কোনও কাজ করবে বা কোনও নির্দেশনামায় সই দেবে, তার আগে একটা কথাই মনে রাখবে যে, তোমার এই নির্দেশ ব্যক্তিগত ভাবে তোমার পরিচিত দরিদ্রতম মানুষটির উপকার করবে না অপকার করবে। যদি বোঝ যে, অপকার করবে, তবে কিছুতেই তাতে মত দেবে না।’ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলতেন, ‘যাঁরা প্রকৃত অর্থে জনগণের সেবা করতে চান, তাঁরা যেন এটা মনে রাখেন যে, তাঁদের বিপজ্জনক রকমের স্বার্থবুদ্ধিহীন হওয়া চাই (দে মাস্ট বি ডেন্জারাসলি আনসেলফিশ)।’
যাঁরা গ্রাম স্তরে ক্ষমতার অধিকারী হন, তাঁদের অনেককেই পঞ্চায়েত সৃষ্টির ইতিহাসের পিছনে কী ভাবনা, তা বোঝাতে হবে। ক্ষমতা যত ক্ষুদ্রই হোক, ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁদের যোগ্য করে তোলার কাজটা করতেই হবে। কেবল কিছু প্রশাসনিক জ্ঞান দিয়ে এ কাজটি হবে না। তাঁদের মানসিক উত্তরণ ঘটানো চাই। রাজনৈতিক দলের কাছেও তাঁরা দায়বদ্ধতা থাকবেনই। দলগুলি যদি ইমোশনাল ইনপুটগুলির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে, সেটা অনেকটা কার্যকর হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হলেই ক্ষমতার সৎ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় না।
অনেক দিন আগের একটি কাহিনি বলি। এক জন সৎ এবং সরল প্রবীণ মানুষ পঞ্চায়েত সমিতিতে নির্বাচিত হয়েছেন। বাজারে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল যে, তিনিই পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হবেন। প্রায়ই আমার বাড়িতে চা খেতে আসতেন। এক দিন সকালে দেখি মহামূল্যবান একটি পাঞ্জাবি এবং ফিনফিনে ধুতি পরে হাজির। আমার চোখ কপালে উঠে গেল। তাঁকে চিরকালই অর্ধ-গরিবের জামাকাপড় পরতে দেখেছি। জিজ্ঞেস করলাম, কী দাদা, কবে থেকে রাজা হলেন? বললেন, ‘আর বলবেন না, আজ সকালে এক জন এই ধুতি-পাঞ্জাবি দিয়ে আমাকে প্রণাম করে ধর্মবাপ ডেকে গেল।’ তিনি যার কথা বললেন, সে লোকটি আমার জানা। ওই অঞ্চলের টিউবওয়েল এবং রাস্তার কন্ট্রাক্টর। এদের ঘ্রাণশক্তি প্রবল। নির্বাচনের আগে থাকতেই কোথায় কী প্রণামী দিতে হয়, এ জানাটা এদের ব্যবসার অঙ্গ। ধর্মপুত্রটিকে পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আগাম খবর কোথায় পেলেন যে উনি সভাপতি হবেন? সেই ব্যক্তি বি ডি ও অফিসের এক আধিকারিকের নাম করে বলল, তাঁর কাছ থেকে জেনেছে। বুঝলাম, বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে! |