প্রবন্ধ ১...
অধিগ্রহণের কাজে পঞ্চায়েতকে চাই

মি অধিগ্রহণ আইন পাশ হয়ে গেল। আইনে ক্ষতিপূরণের যে অঙ্ক স্থির করা হয়েছে, তা কার্যত আকাশছোঁয়া। কিন্তু সেই টাকা দিয়েও জমি পাওয়া যাবে কি? সেই জমিতে শিল্প করা যাবে কি? আর একটি প্রশ্নও উঠছে: সরকারের সাহায্য ছাড়া কি জমি পাওয়া সম্ভব? সরকার শুধু পুলিশ (এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্যাডার) পাঠিয়ে জমি দখল করে দেবে, এই দাবি কোনও সভ্য সমাজ করবে না। কিন্তু ঘটনা হল, গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ জায়গাতেই বাজার সীমিত, অগভীর। এবং, ভারতের বেশির ভাগ মানুষ এখনও বহুলাংশে সরকারের ওপর নির্ভরশীল। যে কোনও কাজের জন্যই মানুষকে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর এক দিকে বিডিও অফিস, অন্য দিকে পঞ্চায়েত নির্ভর করতে হয়। এই নির্ভরশীলতা একটা অভ্যাস। একটা বিশ্বাসের জায়গাও। জমি অধিগ্রহণের ব্যাপারে যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলি সরে যায়, মানুষের অনিশ্চয়তা বাড়বে।
কোন রাজ্যে পঞ্চায়েতের কতখানি ক্ষমতায়ন হয়েছে, সেটাও এখানে প্রাসঙ্গিক। ২০০৫ থেকে কেন্দ্রের পঞ্চায়েতি রাজ মন্ত্রক এক সূচক তৈরি করে। ডিভলিউশন ইনডেক্স বা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সূচক। সেই সূচকের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ প্রথম সারিতে। যেখানে পঞ্চায়েতের হাতে বেশি ক্ষমতা, সেখানে পঞ্চায়েতের কাছে গেলে বেশি কাজ হয়, ফলে সেখানে মানুষ পঞ্চায়েতের ওপর বেশি নির্ভরশীল। কাজেই, এই রাজ্যে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া থেকে পঞ্চায়েতকে সরিয়ে রাখলে মানুষ অসহায় বোধ করবেন। জমি দিলে ক্ষতি হতে পারে, এই অনিশ্চয়তাও বাড়বে। বিশেষত অনুন্নত অঞ্চলে। পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্রের অনুপাত বেশ চড়া ২৬.৭ শতাংশ। ফলে, এই রাজ্যে জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে পঞ্চায়েত না থাকলে মানুষ আরও বেশি ঘাবড়াবেন বলেই আশঙ্কা।
কেউ জমি দিতে অসম্মত মানেই যে কৃষি তাঁর পছন্দের জীবিকা, তা নয়। সিঙ্গুরেই বহু বার শুনেছি, শুধু কৃষির আয়ে সংসার চলে না। নতুন প্রজন্মের সিংহভাগই এখন অন্য কাজ করেন। কৃষি তাঁদের বড়জোর আংশিক বৃত্তি। কথাটা গোটা দেশেই সত্যি। ২০০১ সালে গ্রামীণ ভারতের ৪০.২ শতাংশ মানুষের মুখ্য জীবিকা ছিল কৃষি। ২০১১ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩৩ শতাংশ। এই দুই বছরে পশ্চিমবঙ্গে মোট কর্মনিযুক্ত মানুষের মধ্যে কৃষকের অনুপাত যথাক্রমে ২৫.৫ ও ২০.৬ শতাংশ। কাজেই, মানুষ কৃষিকেই জীবিকা হিসেবে দেখতে চান, এই যুক্তি খাটছে না।
কিন্তু, জমি কি শুধু চাষের রোজগারের জন্যই জরুরি? সিঙ্গুর অঞ্চলে দেখা গিয়েছে, বেশির ভাগ পরিবারেই আয়ের প্রধান উৎস কৃষি। দ্বিতীয়ত, গ্রামাঞ্চলে মানুষের দক্ষতা মূলত কৃষিকেন্দ্রিক। কৃষিজমি না থাকলে তাঁরা অদক্ষ শ্রমিকে পরিণত হবেন। তিন, কৃষিতে চাষের মরসুমে কাজ করলেই হয়, অন্য সময় অন্য পেশায় কাজের সুযোগ থাকে। চার, কৃষিজমি শুধু আয়ের উৎস নয়, তা নিরাপত্তাও দেয়। অসুখবিসুখ, সন্তানের বিয়ে, উচ্চশিক্ষা নানা প্রয়োজনে কৃষিজমি বেচে বা বন্ধক দিয়ে ধাক্কা সামলানো যায়।

উন্নয়নের শরিক? স্থানীয় মানুষকে জায়গা না দিলে শিল্পায়ন চালানো মুশকিল।
এই অবস্থায়, মানুষকে জমি বিক্রিতে রাজি করানোর উপায় কী? শিল্প হলে সেই উন্নয়ন থেকে তাঁরা যে বাদ পড়বেন না, এটা নিশ্চিত করাই একমাত্র পথ। কিন্তু মানুষ তা বিশ্বাস করবেন কেন? অধিগ্রহণ নিয়ে যত আলোচনা, সবেতেই বলা হয়, আগে শিল্পের জমি বাছাই করা হোক, তার পর সেখানকার মানুষকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়েপিটে নেওয়া যাবে। এতে স্থানীয় মানুষের মনে অনেক অনিশ্চয়তা থেকে যায়। শিল্প হলে সেখানে কর্মসংস্থান হবে কি? যদি হয়ও, সে কাজ পাওয়ার যোগ্যতা তাঁদের আছে কি? অঞ্চলের উন্নয়ন থেকে তাঁরা বাদ পড়বেন না তো? এই সব অনিশ্চয়তার যথাযোগ্য সুরাহা না করে, আগে অধিগ্রহণ করে পরে স্থানীয় মানুষকে উন্নয়নের মূল স্রোতে আনার চেষ্টা করলে চলবে না। তাঁদের বিশ্বাসের ফাঁক ভরাট করতে হবে আগে।
জমির ওপর মানুষের যে কারণগুলিতে ভরসা, সরকার যদি সেই নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করে দেয়? তা হলে জমি আঁকড়ে থাকার প্রবণতা কমতেই পারে। কিন্তু তার জন্যও অধিগ্রহণ আরম্ভ হওয়ার ঢের আগে থেকেই মানুষের মনে নিজেদের অবস্থান বিষয়ে নিশ্চয়তা গড়ে তুলতে হবে। এবং, তা করতে হবে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমেই। বিশেষ করে যেখানে স্থানীয় প্রশাসন যথেষ্ট ক্ষমতাবান, সুতরাং মানুষের আস্থাভাজন, সেখানে এটিই উন্নয়ন পৌঁছে দেওয়ার সবচেয়ে কুশলী পথ। নিশ্চয়তা তৈরির তিনটি দিক। প্রথম, মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন, যেমন দু’বেলা খাবারের সংস্থান, সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি, সেগুলো মেটানো বিকল্প পথ তৈরি করা, যাতে সে জন্য কৃষির ওপর নির্ভর করতে না হয়। দ্বিতীয়, শিল্প হলে তাতে কাজে পেতে পারেন, এমন ভাবে মানুষের দক্ষতা তৈরি করা। তৃতীয়, জমির চরিত্রবদলের পর যখন তা ক্রমে বেশি লাভজনক হয়ে উঠবে, সেই লাভ থেকে যাতে জমির আদি মালিকরা, এবং তার ওপর নির্ভরশীলরা, বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করা।
সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা হয়েছিল ২০০৬ সালে। সেই বছরই কেন্দ্রীয় সরকার গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন তৈরি করে। সিঙ্গুরে যাঁরা আন্দোলন আরম্ভ করেন, তাঁরা ছিলেন প্রধানত কৃষিশ্রমিক। অর্থাৎ, অদক্ষ গ্রামীণ শ্রমিক। ঠিক এই শ্রেণির মানুষই গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পে কাজ পান। ২০১৩ সালে সিঙ্গুরে দেখেছি, এই প্রকল্পের কাজ মন্দ চলছে না। হুগলি জেলারই অন্যত্র হওয়া সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আগে যাঁরা সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর ছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশ কর্মসংস্থান প্রকল্পে অদক্ষ কায়িক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। অর্থাৎ, খাওয়া-পরার জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা খানিক হলেও কমেছে। ২০০৬ সালের বদলে যদি ২০১৩-এ সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের চেষ্টা হত, তা হলেও একই পরিমাণ প্রতিরোধ হত কি?
কর্মসংস্থান প্রকল্প রোজগারের নিশ্চয়তা দিতে পারে। তার পাশাপাশি যদি যথার্থ পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়, দ্বিগুণ লাভ হবে। প্রথমত, সন্তানের শিক্ষার জন্য টাকার সংস্থানের চিন্তা অন্তত কিছুটা কমবে। দ্বিতীয়ত, ক্লাস এইট পর্যন্ত যদি সবাই ভাল ভাবে লেখাপড়া শেখে, তবে তারা নিজেদের যোগ্যতায় আস্থাবান হবে, তাদের শিল্পের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়াও সহজ হবে। ‘শিল্প হলে আমরাও তাতে কাজ পাওয়ার যোগ্য’ এই বিশ্বাস তৈরি করা খুব দরকার। সিঙ্গুরে দেখেছি, মা-বাবারা চান না সন্তানও কৃষিতেই আটকে থাকুক, কিন্তু যত ক্ষণ না ভরসা করার মতো বিকল্প তৈরি হচ্ছে এবং বিকল্পে যোগ দিতে পারার মতো ভরসা নিজের সম্বন্ধে তৈরি হচ্ছে, তত ক্ষণ কৃষিই নির্বিকল্প। অ-বিশ্বাসের এই চক্রটি ভাঙতে শিক্ষার অধিকার আইন মোক্ষম হাতিয়ার হতেই পারে।
তা হলে কী ভাবে এগোনো উচিত? শিল্পায়নের উপযুক্ত যত জমি এই রাজ্যে আছে, সব ক’টিকে নথিভুক্ত করা হোক। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সেখানে যথাযথ উন্নয়ন প্রকল্পগুলি পুরোদমে চালু করা হোক এমন ভাবে, যাতে স্থানীয় মানুষের অবস্থার সত্যিই উন্নতি ঘটে, জমি-নির্ভরতা কমে। এতে আর একটি পরোক্ষ লাভ হতে পারে। একটি অঞ্চল শিল্পায়নের জন্য মনোনীত হলেই যদি উন্নয়নের পালে হাওয়া লাগে, তবে বহু এলাকাতেই শিল্পায়নের পক্ষে জনমত তৈরি হবে। ফলে, এখন যেমন ওপর থেকে শিল্পায়নের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়, ভবিষ্যতে হয়তো উল্টো দিক থেকে শিল্পায়নের দাবি আসবে। এমনটা যে হবেই, নিশ্চিত হয়ে বলার উপায় নেই। কিন্তু হতে পারে কি না, দেখা প্রয়োজন।
আরও দুটো কথা মনে রাখতে হবে। প্রথমত, ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক আর দশ একর জমির মালিকের প্রয়োজন এক হতে পারে না। সবার জন্য এক ব্যবস্থা করলে চলবে না। ক্ষতিপূরণের অঙ্কের পাল্লা এখনও জমির মালিকের দিকেই ঝুঁকে আছে। জমি অধিগ্রহণের জমি তৈরির সময় আর্থিক, শিক্ষাগত শ্রেণি অনুসারে বিভিন্ন গোত্রের মানুষের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা দরকার। যে উন্নয়ন হবে, সবাই যাতে তার অংশীদার হতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা দরকার। এবং, এটা করতে হবে সরকারকেই। শিল্পায়নের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা সরকার নিজের দায়িত্ব বলে মনে না-ই হতে পারে, কিন্তু এলাকার উন্নয়ন তো সরকারেরই দায়িত্ব। তাতে শিল্পায়নে লাভ হলে সেটা না হয় সরকার ফাউ হিসেবেই নিল।
দ্বিতীয়ত, কোন এলাকার মানুষ সরকারের ওপর কতখানি নির্ভরশীল, সেটাও বিবেচ্য। কোনও রাজ্যেই সব অঞ্চল সরকারের ওপর সমান নির্ভরশীল নয়। পশ্চিমবঙ্গেও নয়। পুরুলিয়ার কোনও গ্রাম তার প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি পূরণের জন্যও সরকারের ওপর যতখানি নির্ভরশীল, সিঙ্গুর তার তুলনায় ঢের কম। সরকার-নির্ভরতার একটা বড় মাপকাঠি শহর থেকে সেই অঞ্চলের দূরত্ব। এই নির্ভরশীলতার বহু দিক আছে। একটা উদাহরণ দিই। সিঙ্গুর থেকে রোজ সকালে বহু মানুষ কলকাতা, শ্রীরামপুর, লিলুয়ায় আসেন। কাঠের কাজ থেকে নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি, হরেক কিসিমের কাজ করেন তাঁরা। দিনের শেষে তাঁরা সিঙ্গুরে ফিরে যান। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের মানুষের পক্ষে এই ভাবে জীবিকা অর্জন সম্ভব নয়। হয় তাঁদের পাকাপাকি ভাবে অন্যত্র থাকতে হয়, নয়তো স্থানীয় ভাবে জীবিকার সন্ধান করতে হয়। যেহেতু বাজার সীমিত, তাই তাঁরা বেশি করে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন।
সরকারের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের নির্ভরশীলতার সম্পর্কটি ঠিক কেমন এবং সেই নির্ভরশীলতা কতখানি দুটো প্রশ্নের উত্তরই ঠিক করে দেবে, জমি অধিগ্রহণের প্রস্তুতি কী ভাবে করা উচিত। সিঙ্গুরে হয়তো কর্মসংস্থানের চেয়ে বেশি জোর দিতে হবে নাগরিক পরিকাঠামো নির্মাণে। রঘুনাথপুরে হয়তো অনেক বেশি প্রয়োজন স্কুল এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হাল ফেরানোর। কোথায় কী করণীয়, সেটা বাস্তব অবস্থা ও প্রয়োজন অনুযায়ী স্থির করতে হবে। কিন্তু কিছু যে করতেই হবে, তা নিয়ে সংশয় নেই। অধিগ্রহণের জমি তৈরি না করেই শিল্পের জন্য জমি জোগাড় করতে নামলে ফের ধাক্কা খেতে হবে। আকাশছোঁয়া ক্ষতিপূরণ সত্ত্বেও।

সন্দীপ মিত্র কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে অর্থনীতির শিক্ষক। মতামত লেখকদের ব্যক্তিগত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.