কারণ না থাকিলে কার্য উৎপন্ন হয় না। কিন্তু কার্যকারণসূত্র প্রায়শ জটিল। শনিবার কংগ্রেসের সাংবাদিক বৈঠকে দলের সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী যে বিচিত্র কাণ্ড করিয়াছেন, তাহার সত্য কারণ তিনি নিজে হয়তো জানেন, অন্তত ‘মানুষ কি তাহার আপন আচরণের কারণ সত্যই জানে’ বলিয়া গূঢ় দার্শনিক প্রশ্ন না-হয় মুলতুবি থাকিল। কিন্তু অন্যেরা কেবল সম্ভাব্য কারণগুলি বিচার করিতে পারে। রাহুল গাঁধীর এই আচরণের সহজতম ব্যাখ্যা সম্ভবত ইহাই যে, সমগ্র ঘটনাটি পরিকল্পিত। সাদা বাংলায়, ‘সাজানো’। দণ্ডিত সাংসদদের রক্ষা করিবার জন্য আনীত অর্ডিনান্সটি জনমানসে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করিয়াছে এবং বিজেপি-সহ বিভিন্ন দল যে ভাবে তাহার বিরুদ্ধে মত দিয়াছে, তাহাতে শঙ্কিত হইয়া কংগ্রেসের নেতারা পিছু হটিতে চাহিয়াছেন এবং সেই পশ্চাদপসরণকে ‘সৎ রাজনীতি’র মোড়কে পুরিয়া বিপণনের লক্ষ্যে তরুণ সহ-সভাপতিকে সত্যবান বিদ্রোহীর ভূমিকায় মঞ্চে নামাইয়া দিয়াছেন, ভাবিয়াছেন এই সুযোগে তাঁহার একটি উন্নততর ভাবমূর্তি রচনা করিয়া লইতে পারিলে মন্দ কী? তরুণ নায়ক উত্তেজনার বশে অতি-অভিনয় করিয়া ফেলিয়াছেন, সেই কারণেই দল এবং সরকার এখন সমস্যায় পড়িয়াছে।
এই ব্যাখ্যা যদি সত্য হয়, তবে বলিতেই হইবে, কংগ্রেসের কাণ্ডজ্ঞানের ভাণ্ডারে ঘাটতির পরিমাণ চিদম্বরমের বাজেটকেও হার মানাইবে। সহজ সত্য হইল, এমন তঞ্চকতা দ্বারা অল্পসংখ্যক মানুষকে অল্প দিনও বিভ্রান্ত করা যায় না। সততার রাজনীতি যদি করিতেই হয়, তবে খোলাখুলি তাহাই করিতে হইবে, লালুপ্রসাদ আদি শরিক বা বন্ধুবান্ধবকে, এমনকী আপন দলের অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিরা বিপন্ন হইলেও সুপ্রিম কোর্টের যথাযথ নির্দেশকেই মান্য করিতে হইবে। অন্য একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হইতে পারে যে, অর্ডিনান্সটির প্রশ্নে কংগ্রেসের শীর্ষস্তরে মতানৈক্য আছে, এবং তাহার পরিণামেই সহ-সভাপতি তাঁহার সভাপতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছেন। এই ব্যাখ্যায় নাটকীয়তা বিস্তর। কিন্তু সেই প্রশ্ন সরাইয়া রাখিলেও বলিতেই হয় যে, এমন মতানৈক্য নিরসনের জন্য সাংবাদিক বৈঠকে নাটক করিবার প্রয়োজন কী? দলের অন্দরমহলেই তো বোঝাপড়া করিয়া লওয়া উচিত ছিল। সভাপতি এবং সহ-সভাপতির পরস্পর কথা বলিবার সুযোগ হয় না, এমন কথা মনে করিবার তো কারণ দেখা দেয় নাই।
তৃতীয় যে ব্যাখ্যাটি বাতাসে ভাসিতেছে, তাহা এইরূপ যে, এতদ্দ্বারা কংগ্রেস দল হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর আপন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে, রাহুল গাঁধী দলের সেনাপতি ও প্রতীক। আবারও প্রশ্ন উঠে, সরকার এবং দলের সমন্বয় এমনই অতলে পৌঁছাইয়াছে যে সাংবাদিক বৈঠকে অভ্যুত্থান ঘটাইতে হয়? এহ বাহ্য। কংগ্রেস দলের আপত্তির অর্থ তো ‘হাই কমান্ড’-এর আপত্তি। দণ্ডিত সাংসদদের রক্ষা করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সনিয়া গাঁধীর অসম্মতি অগ্রাহ্য করিয়া অর্ডিনান্স জারি করিয়াছেন, এমন তত্ত্ব বিশ্বাস করিবার মতো আহাম্মক এই জনবহুল দেশেও খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন হইবে। সম্ভাব্য ব্যাখ্যার তালিকা দীর্ঘতর হইতে পারে, কিন্তু ব্যাখ্যা যাহাই হউক, সম্পূর্ণ অনৈতিক অর্ডিনান্সটি জারি করিয়া কংগ্রেস তথা সরকার যে বিপাকে পড়িয়াছে, তাহাকেই স্বখাতসলিল বলে। প্রধানমন্ত্রী আপন সম্মান কী করিয়া বাঁচাইবেন তিনিই জানেন, কিন্তু অবিলম্বে অর্ডিনান্সটি প্রত্যাহার করিলে ভারতীয় গণতন্ত্রের মঙ্গল হইবে। |