|
|
|
|
|
ভোটে কালো টাকা শাসনের
দাওয়াইয়ে সব দলই ফ্যাসাদে নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
|
সে বার বিপদ বাঁধিয়েছিলেন বিজেপি নেতা গোপীনাথ মুন্ডে। এ বার ছোট-বড় সব ক’টি রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ভোটে কালো টাকার ব্যবহার রুখতে তাদের ১০ দফা প্রস্তাব নিয়ে কোনও দলই আপত্তি করছে না। কিন্তু সব দলের নেতারাই ঘরোয়া আলোচনায় কবুল করছেন, ওই সব দাওয়াই মেনে চলতে হলে সেটা বেশ সমস্যার হবে।
মাস তিনেক আগে গোপীনাথ মুন্ডে মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিলেন, গত লোকসভা নির্বাচনের সময় প্রচারে তাঁকে ৮ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছিল। অথচ কমিশনের বেঁধে দেওয়া সীমা ছিল মাত্র ২৫ লক্ষ টাকা। গোপীনাথের যুক্তি ছিল, এত কম টাকায় ভোটে জেতা যায় না!
নির্বাচন কমিশন ২০০৯-এ ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছিল ২৫ লক্ষ টাকা। সেটাই বাড়তে বাড়তে এখন ৬০ লক্ষে পৌঁছেছে। কিন্তু সব দলের নেতারাই জানেন, প্রচারের খরচ এত কম টাকায় আটকে থাকে না। আর খরচের বেশির ভাগটাই হয় নগদে। সরকারি খাতাপত্রে যার কোনও হিসেবনিকেশ থাকে না। যার মধ্যে অনেকটাই কালো টাকা।
আগামী লোকসভা ভোটে এই কালো টাকার ব্যবহার রুখতেই কমিশন এ বার কোমর বেঁধে মাঠে নামতে চাইছে। লোকসভা ভোটের আগে আগামী নভেম্বরে দিল্লি, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় এবং মিজোরামে বিধানসভা নির্বাচন। এই পাঁচ রাজ্যের ভোটেই কালো টাকা রোখার মহড়া শুরু করতে চাইছে কমিশন। তার জন্য মাসখানেক আগে তারা দশ দফা প্রস্তাব পাঠিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলির কাছে। সেই চিঠি পেয়ে ভাঁজ পড়েছে সব দলের নেতাদের কপালেই।
কারণ, কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে, দলের সমস্ত চাঁদা ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে জমা রাখতে হবে। প্রার্থীদের নির্বাচনী খরচের টাকাও দিতে হবে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মাধ্যমেই। অর্থাৎ যাবতীয় লেনদেন করতে হবে অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক, ড্রাফট বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে। নির্বাচনের সময় প্রার্থী বা দলের নেতারা অনেক সময়ই বিপুল নগদ নিয়ে ঘুরে বেড়ান। ওই টাকা প্রচারের সময় ভোটারদের মধ্যে বিলি করা হয় বলেও কমিশনের কাছে অভিযোগ এসেছে। তাই তাদের প্রস্তাব, নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন কোনও প্রার্থী বা দলের নেতা-কর্মী কী পরিমাণ নগদ টাকা সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন, তারও ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হোক। এখানেই শেষ নয়। কমিশনের দশ দফা প্রস্তাবের একটিতে এ-ও বলা হয়েছে যে, দলের তরফে প্রার্থীর কাছে অর্থ ব্যয়ের শংসাপত্র বা ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ চাওয়া হোক। অর্থাৎ টাকা যে শুধুমাত্র প্রচারের কাজেই খরচ হয়েছে, তা প্রমাণ করে নথিপত্র জমা দিতে হবে প্রার্থীকে। সেই নথি পরে খতিয়ে দেখবে নির্বাচন কমিশন।
রাজনৈতিক দলগুলির মূল আপত্তি এখানেই। তাঁদের বক্তব্য দু’টি। এক, এই ভাবে সব খরচের হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়। দুই, চাইলে যে কেউ নকল নথি জমা দিতে পারে। কাজেই এই ভাবে কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। নির্বাচন কমিশন কিন্তু তা মানতে রাজি নয়। কমিশন-কর্তাদের যুক্তি, নির্বাচনী ব্যয় নজরদারির জন্য বিশেষ সেল তৈরি হচ্ছে। আয়কর দফতরের গোয়েন্দাদেরও কাজে লাগানো হবে। প্রচারের সময় গাড়ি, খাবার, জনসভা, প্রচারপত্র বিলি, পোস্টার-ব্যানারের পিছনে কোন প্রার্থী কত টাকা খরচ করছেন, তা ভিডিও রেকর্ডিং করে রাখা হবে। প্রতিটি জিনিসের বাজারদর নথিভুক্ত করা হবে। নজরদারি সেলের আধিকারিকরা প্রতিটি প্রার্থীর সঙ্গে থেকে নিজের মতো করে হিসেব রাখবেন, কোথায় কত আনুমানিক খরচ হচ্ছে। সেই আনুমানিক খরচের সঙ্গে প্রার্থীর পেশ করা আসল খরচের হিসেব মিলিয়ে দেখা হবে। দুইয়ের মধ্যে অস্বাভাবিক ফারাক দেখা গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
কী বলছে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান দুই যুযুধান দল তৃণমূল এবং সিপিএম?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত কালই মন্তব্য করেছেন, “পশ্চিমবঙ্গের বাইরের লোকেদের ধারণা নেই তৃণমূল কতটা স্বচ্ছ দল!” সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের চিঠির প্রসঙ্গে সিপিএমের তহবিলের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। আজ তৃণমূলের রাজ্যসভার মুখ্য সচেতক ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, “আমরা যে কোনও স্তরে দলের আয়ব্যয়ের তথ্য জানাতে প্রস্তুত। মনে রাখতে হবে, আমাদের দলই সরকারি ব্যয়ে ভোট করানোর পক্ষে সওয়াল করে আসছে সব চেয়ে আগে থেকে।” সিপিএম-ও কমিশনের প্রস্তাবে কোনও আপত্তি তুলছে না। কিছু দিন আগেই পার্টির টাকা ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে রাখা নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। তা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বর ক্ষোভের মুখেও পড়তে হয় রাজ্য নেতৃত্বকে। দলের পলিটব্যুরো সদস্য এস আর পিল্লাই বলেছেন, “কমিশন যে সব প্রস্তাব দিয়েছে, এখনই তার অনেকগুলি মেনে চলি। আমরা কমিশনকে জানিয়েছি, বাকি প্রস্তাবেও আমাদের আপত্তি নেই।”
জাতীয় ক্ষেত্রেও কোনও রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে রাজি নয়। কংগ্রেসের মুখপাত্র সন্দীপ দীক্ষিত থেকে শুরু করে বিজেপি-র প্রকাশ জাভড়েকর, দু’জনেরই যুক্তি, নির্বাচনে স্বচ্ছতা আনতে যে কোনও শর্ত মানতেই তাঁরা রাজি। সন্দীপ দীক্ষিতের বক্তব্য, “কংগ্রেস এমনিতেই এই সব মেনে চলে।” আর জাভড়েকর বলছেন, “বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী তো কালো টাকা রুখতেই রথযাত্রা করেছেন। আমরা কেন এতে আপত্তি করব!” কিন্তু ঘরোয়া আলোচনায় সব দলের নেতারাই স্বীকার করছেন, কমিশনের বিধিনিষেধ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হলে সমস্যা হবে। বহুজন সমাজ পার্টি বা সমাজবাদী পার্টির মতো দলের নেতাদেরও একই বক্তব্য। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মায়াবতীর দলের দু’জন প্রার্থীর ঘোষিত সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি টাকার বেশি। এ বার দিল্লির নির্বাচনেও প্রার্থী দেবে মায়াবতীর দল। তারা দেদার টাকা ওড়াবে, এখন থেকেই এই অভিযোগে সরব অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি।
ভোটে কালো টাকার ব্যবহার রুখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কমিশন কিন্তু হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে, বিধি না মানলে খারিজ হতে পারে জয়ী প্রার্থীর বিধায়ক বা সাংসদ পদও। |
|
|
|
|
|