মার্কিন প্রশাসনে তালা পড়ে যাওয়ার হাতেগরম নমুনা একেবারে সামনে থেকে দেখল কলকাতা!
মঙ্গলবার বণিকসভা ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্সের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল হেলেন লাফেভ। উপলক্ষ্য, ওই পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম বার এ শহরের শিল্প প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপচারিতা। কিন্তু সেখানে পৌঁছে লাফেভ জানালেন, এমন রুটিন, আপাদমস্তক অবিতর্কিত অনুষ্ঠানে আসার জন্যও ওবামা-প্রশাসনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়েছে তাঁকে। মঞ্চে ওঠার পর সরিয়ে দেওয়া হল কনস্যুলেটের আর এক প্রতিনিধির পরিচয় লেখা বোর্ডও। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেল, বাজেট পাশ না-হওয়ার দরুন মার্কিন প্রশাসনের এক বড় অংশে তালা পড়ে যাওয়ায় এই মুহূর্তে সরকারি ভাবে ছুটিতে চলে গিয়েছেন তাঁরা। তাই কূটনীতিক হিসেবে ভারতের মাটিতে কোনও বিবৃতি দেওয়ার অধিকার এই মুহূর্তে একমাত্র অনুমতি নেওয়া লাফেভেরই। |
কলকাতার এক রুটিন অনুষ্ঠানেও ওবামা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে
হাজির হলেন মার্কিন কনসাল জেনারেল হেলেন লাফেভ। |
মার্কিন সরকারের নতুন আর্থিক বছর শুরু হয় ১ অক্টোবর থেকে। তার আগে সেখানে সরকার ও বিরোধী পক্ষের ‘ঝগড়া’ না-মিটলে, বাজেট পাশ হবে না বলে আশঙ্কা ছিল অনেক দিন থেকেই। ভারতীয় সময় অনুযায়ী মঙ্গলবার ভোর রাতে দেখা গেল, রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে সত্যিই পাশ হল না মার্কিন বাজেট। তাই সরকারি তহবিল থেকে টাকা খরচের উপায় নেই। ফলে বন্ধ হয়ে গেল অনেক প্রশাসনিক কাজকর্ম। গত ১৭ বছরে এই প্রথম। বিল ক্লিন্টনের পর ফের বারাক ওবামার জমানায়।
এর জেরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবেতন ছুটিতে যেতে বাধ্য হলেন প্রায় ১০ লক্ষ সরকারি কর্মী। দরজা বন্ধ হল মার্কিন শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক এসইসি-র। তালা পড়ে গেল ১৪০টি ন্যাশনাল পার্ক, মনুমেন্টের মতো বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানে। প্রশাসনের চাকা আংশিক ভাবে থমকে যাওয়ায় আপাতত বেরোবে না কোনও সরকারি পরিসংখ্যান। শ্লথ হবে বিচার ব্যবস্থার গতি। প্রভাব পড়বে বন্দর এবং বিমানবন্দরেও। তবে চালু থাকবে সামরিক বাহিনী, সামাজিক সুরক্ষার মতো কিছু অত্যাবশ্যক পরিষেবা।
সার্বিক ভাবে এ দেশের শিল্পমহল মনে করে, মার্কিন প্রশাসনের একটা বড় অংশ বন্ধ থাকা এখনই হয়তো বিরাট ধাক্কা দেবে না ভারতীয় অর্থনীতিকে। কিন্তু দীর্ঘ দিন তালা না-খুললে, অবশ্যই তা চিন্তার।
এই খবরে এখনই কপালে ভাঁজ ভারতীয় রফতানিকারীদের। তাঁরা মনে করছেন, মন্দার ছায়া সরিয়ে সবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল মার্কিন অর্থনীতি। এই অবস্থায় সেখানকার সরকারি কর্মীরা (যাঁদের অনেকেরই বেতন বেশ ভাল) টাকা না-পেলে, ফের চাহিদা কমবে সেখানে। তার উপর বন্দরে বিভিন্ন কাজ ব্যাহত হওয়ায় গুনতে হবে আর্থিক ক্ষতিও।
|
ওয়াশিংটনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৌধের সামনে ঝোলানো হচ্ছে বন্ধের নির্দেশ। |
এ দেশে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ন্যাসকম জানিয়েছে, ব্যবসায় লোকসানের সম্ভাবনা অন্তত এখনই নেই। কিন্তু ভিসা পাওয়া শক্ত হবে কি না, তা নিয়ে তারা চিন্তিত। কিন্তু লাফেভের আশ্বাস, “আমাদের কাছে এই ঘটনা নিশ্চয়ই চিন্তার, উদ্বেগের। কিন্তু ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে এর কোনও প্রভাব পড়বে না।”
এ বার বাজেট নিয়ে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে মন কষাকষির প্রধান কারণ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার চালু করা সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত আইন। যা ‘ওবামা-কেয়ার’ নামে পরিচিত। মার্কিন মুলুকে কম খরচে প্রায় সবাইকে চিকিৎসা পরিষেবার আওতায় আনতে ২০১০ সালে ওই বিলকে আইনে পরিণত করেছেন ওবামা। চলতি মাস থেকে তার একটা বড় অংশ সত্যি সত্যিই কার্যকর হওয়ার কথা।
কিন্তু এখানেই বেঁকে বসেছে বিরোধী রিপাবলিকানরা। গোড়া থেকেই তারা এই আইনের বিরোধী। তাদের যুক্তি, এটি আসলে করদাতাদের অর্থের বিপুল অপচয়। বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমার সর্বনাশও। এই যুক্তিতে ভর করেই মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি সভায় (হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ) ওবামা-কেয়ারকে আপাতত এক বছর পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল সেখানে সংখ্যাগুরু রিপাবলিকানরা। জানিয়েছিল, একমাত্র তবেই সরকারি খরচপত্রের বিল পাশ করবে তারা। কিন্তু এই প্রস্তাব পত্রপাঠ ফিরিয়ে দিয়েছে অপর কক্ষে (সেনেট) সংখ্যায় ভারী ডেমোক্র্যাটরা। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দল স্পষ্ট করে দিয়েছে, কোনও ভাবেই ওবামা-কেয়ারকে ‘বলি দিয়ে’ সরকারি খরচের বিল পাশে এগোতে চায় না তারা। শেষ দিন পর্যন্ত বিস্তর কথার লড়াই, দড়ি টানাটানির পরও এই জট না-খোলার জন্যই ১৭ বছর পর ফের তালা পড়ল মার্কিন প্রশাসনের এক বড় অংশে।
বিরক্ত ওবামা রিপাবলিকানদের তুলোধোনা করে বলেছেন, “ওঁরা সরকার চালানোর জন্য মুক্তিপণ দাবি করছেন। মার্কিন নাগরিকদের চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করতে ওঁরা আদর্শগত ধর্মযুদ্ধে নেমেছেন। আর তা করতে গিয়ে প্রশাসনে তালা ঝুলিয়ে দিলেন।” প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জুলিয়ান জেলিফার একে বলছেন ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনৈতিক নাটক’। মার্কিন নাগরিকদেরও একটা বড় অংশ মনে করছেন, এর ফলে ফের এক বার গভীর আর্থিক অনিশ্চয়তায় সেঁধিয়ে যাচ্ছে সবে মন্দা থেকে মাথা তুলতে শুরু করা আমেরিকা। |
কারণ, এর পর মাঝ-অক্টোবরেই আসতে চলেছে ঋণের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানোর প্রস্তাব। বর্তমানে ১৬.৭ লক্ষ কোটি ডলার পর্যন্ত ধার করতে পারে আমেরিকা। কিন্তু যা পরিস্থিতি, তাতে এ মাসে তা ফের না-বাড়ালে, অনেক খরচই চালাতে পারবে না ওবামার দেশ। মেটাতে পারবে না পুরনো ধারও। সে ক্ষেত্রে ইতিহাসে প্রথম বার সময়মতো বকেয়া না-মেটানোর ‘লজ্জা’য় পড়বে তারা। খরচ মেটানোর মতো অর্থ থাকবে না মার্কিন ট্রেজারির। বেতন পাবেন না সরকারি কর্মীরা। দেওয়া যাবে না সামাজিক সুরক্ষা খাতের অর্থ। টান পড়বে প্রতিরক্ষা তহবিলেও। আতঙ্ক তৈরি হবে সারা বিশ্বের মূলধনী বাজারে। পৃথিবী জুড়ে ফের তৈরি হবে মন্দার সম্ভাবনা।
আমেরিকা-সহ সারা দুনিয়ার আশঙ্কা, এ ভাবে দুই দলের তাল ঠোকাঠুকি যদি মাঝ অক্টোবর পর্যন্ত জারি থাকে, তা হলে ঋণের ঊর্ধ্বসীমা নিয়েও ঐকমত্য হবে না। ফলে ফের মন্দায় ডুবে যাবে
মার্কিন মুলুক। আঁধার ঘনাবে সারা বিশ্বেই। তবে অন্তত রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার খাতিরে এই পরিস্থিতি এড়াতে দু’পক্ষ দ্রুত সমঝোতায় আসার চেষ্টা করবে বলে আশা করছেন সকলে।
কলকাতার এক রুটিন অনুষ্ঠানেও ওবামা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে হাজির হলেন মার্কিন কনসাল জেনারেল হেলেন লাফেভ। ও দিকে, ওয়াশিংটনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৌধের সামনে ঝোলানো হচ্ছে বন্ধের নির্দেশ।
|