উত্তর ও পূর্ব শ্রীলঙ্কার তামিলপ্রধান প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় কি না, তা দেখার জন্য কমনওয়েল্থ ও দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা গোষ্ঠীর (সার্ক) দুটি প্রতিনিধিদল আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় দ্বীপরাষ্ট্রে হাজির ছিল। দুই দলেরই সদস্যদের বক্তব্য, শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী এই নির্বাচনে শাসক দলের প্রার্থীদের হয়ে কাজ করেছে, বিরোধী তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের (টিএনএ) প্রার্থী ও কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়েছে, মারধরও করেছে। তা সত্ত্বেও যে টিএনএ বিপুল জয় হাসিল করে প্রাদেশিক পরিষদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি গরিষ্ঠতা পেয়েছে, সেটা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। এটা দেখিয়ে দেয়, প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষে ও তাঁর দল ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ ফ্রন্ট অ্যালায়েন্স জাফনা, কিলিনোচ্চি, ভাবুনিয়া, মান্নার, মুল্লাইতিভু ইত্যাদি সব ক’টি তামিলপ্রধান জেলাতেই ভোটারদের দ্বারা বিপুল ভাবে প্রত্যাখ্যাত। তাঁর ‘তামিল ক্ষতে প্রলেপ লাগানো’র দাবি অন্তঃসারশূন্য।
এই নির্বাচন ছিল কতকটা ভারতীয় অঙ্গরাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচনের মতো। শ্রীলঙ্কাকে মোট তিনটি প্রদেশে ভাগ করে সেগুলিতে প্রাদেশিক শাসন কায়েম করার লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালের ভারত-শ্রীলঙ্কা চুক্তি অনুযায়ী শ্রীলঙ্কার সংবিধানে যে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয়, তার অঙ্গ হিসাবেই এই নির্বাচন। লক্ষ্যদেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংখ্যালঘু তামিলদেরও স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর করা। এই স্বশাসনের সীমা নিয়ে প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারতুঙ্গার সঙ্গে এলটিটিই-র নিরবচ্ছিন্ন কাজিয়া শেষ পর্যন্ত গোটা সংশোধনী ও তার উদ্দেশ্যকেই বানচাল করে দেয়। ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন নস্যাৎ হয়ে যায় এলটিটিই-র সন্ত্রাস ও ইলম বিচ্ছিন্নতাবাদের উপর্যুপরি হামলায়। ২৫ বছর পরে আবার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। এই নির্বাচনকে ঘিরে তামিল জনসাধারণের ব্যাপক উদ্দীপনা, ভোটগ্রহণের দিন বুথে-বুথে উৎসাহী ভোটদাতাদের দীর্ঘ লাইন বাস্তবিকই গোটা প্রক্রিয়াটিকে একটা উৎসবের চেহারা দেয়। এলটিটিই-মুক্ত তামিল জনপদগুলি যে সন্ত্রাসের দম-বন্ধ-করা স্বৈরাচারের চেয়ে গণতন্ত্রের সুস্মিত বহুত্ববাদকেই বরণ করতে উৎসুক, সেটা তারা এদিন দ্ব্যর্থহীন ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। পছন্দের অধিকার দিলে জনসাধারণ যে গণতন্ত্রকেই পছন্দ করবে, সন্ত্রাসকে নয়, তা তো জানাই ছিল। |
উৎসুক অপেক্ষা। তামিল ভোটদাতারা। জাফনা, সেপ্টেম্বর ২০১৩। ছবি: এ এফ পি। |
এই নির্বাচন অতএব শ্রীলঙ্কার তামিল রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে একটা নতুন সূচনা। এমন নয় যে, দ্বীপভূমির তামিলরা সিংহলিদের সঙ্গে সমানাধিকার পাচ্ছে। এমনও নয় যে রাষ্ট্র তাদের প্রতি কোনও বৈষম্য করছে না, সেনাবাহিনী ও পুলিশ সব তামিলকেই সম্ভাব্য গেরিলা বা গেরিলা-সমর্থক ভাবছে না, তাদের উপর কোনও নজরদারি চলছে না, চারিদিকে শান্তিকল্যাণ বিরাজ করছে। বরং পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টোই। তামিলরা এখনও ভীত-সন্ত্রস্ত। কখন কাকে সেনা বা পুলিশ এসে মিথ্যা অভিযোগে কিংবা স্রেফ সন্দেহের বশে তুলে নিয়ে যায়, তার পর আর তার হদিশ পাওয়া যায় না, সে ‘নিখোঁজ’-এর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, সর্বদাই সেই ভয়। মহিলাদের ভয় দ্বিগুণ, কেননা গৃহযুদ্ধের শেষ পর্বে এবং তার পর শরণার্থী শিবিরে তাঁদের অনেককেই জবাবদিহির দায়মুক্ত সিংহলি নিরাপত্তা বাহিনীর লালসার শিকার হতে হয়েছে। স্বামী বা পুত্র গেরিলা দলে নাম লিখিয়েছিল, এমন অভিযোগই তামিল মহিলাদের ধর্ষণ করার পক্ষে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে পর্যাপ্ত এবং বৈধ যুক্তি ছিল। তাঁরা তাই একা কোথাও বের হতেই ভয় পান। তবু কেন তাঁরা এই নির্বাচনকে বয়কট করে, সিংহলি রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া বন্দোবস্ত হিসাবে বর্জন করে ঘরে খিল এঁটে রইলেন না? কারণ তাঁরা এলটিটিই-র জমানার সঙ্গে তুলনা করে বর্তমান জমানাকে সম্ভবত অধিকতর ভয়ঙ্কর মনে করেননি।
এলটিটিই-রও কোনও জনপ্রতিনিধিত্বের বৈধতা ছিল না। জনগণের ভালবাসা নয়, বন্দুকের নলই ছিল তার ক্ষমতার উৎস। যখন তাদের বন্দুকের চেয়েও শক্তিশালী ও মারণক্ষমতাসম্পন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের সম্মুখীন হতে হল, তখন তাই তারা ভেঙে পড়ল, তাদের ক্ষমতার উৎস গেল শুকিয়ে। এলটিটিই-র বন্দুকের জায়গা নিয়েছে এখন সিংহলি সেনাদের বন্দুক। কিন্তু তারা তামিল মায়েদের কোল খালি করে নাবালক ছেলেদের গেরিলা হতে বাধ্য করছে না, এলটিটিই-র ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ যা করেছিলেন। সর্বোপরি ‘শত্রুরাষ্ট্র’-র বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের সময় নিরস্ত্র তামিল নারীশিশুবৃদ্ধদের ঢাল হিসাবে গুলি-বোমা-ট্যাক-সাঁজোয়া-সঙিনের সামনে এগিয়ে দিয়ে তার আড়ালে কাপুরুষের মতো আত্মরক্ষার গেরিলা কৌশল এই সিংহলি সেনারা অবলম্বন করে না। বাছতেই যদি হয় অর্থাৎ যদি বেছে নেবার স্বাধীনতাই থাকে, তা হলে তামিলরা এলটিটিই-র স্বৈরাচারের চেয়ে রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া গণতন্ত্রকেই যে বরণ করবেন, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
তাই ভোটগ্রহণ তামিল জনপদে উৎসবের চেহারা নেয়। দীর্ঘ আড়াই দশকের গৃহযুদ্ধদীর্ণ দ্বীপরাষ্ট্রের সংখ্যালঘুরা উপলব্ধি করেছেন, বন্দুক নয়, তাঁদের চাই পরিষদীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা, আইনসভায় নির্বাচিত তামিল জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতি, যা কলম্বোর সিংহলি সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করবে তামিলদের স্বশাসনের সীমান্ত প্রসারিত করতে, দরাদরি করবে তামিলপ্রধান জনপদগুলির উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কেন্দ্রীয় তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে। ইলম যখন একটি কল্পরাষ্ট্রের মরীচিকা হয়েই অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন নিজেদের প্রাপ্য অধিকার হাসিল করার এ ছাড়া আর কী পথই বা খোলা আছে?
প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল শ্রীলঙ্কার সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সি ভি বিঘ্নেশ্বরণকে উত্তরের প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরেছে। তাঁকে অতঃপর মহিন্দা রাজাপক্ষের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে, ঠিক যেমন রাজাপক্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারকেও বিরোধী টিএনএ শাসিত উত্তরের প্রদেশের সঙ্গে কাজ করতে হবে। উভয় তরফেই যে সমূহ নমনীয়তা আবশ্যক, তাতে সন্দেহ নেই। রাজাপক্ষে এমনিতে খুব সহিষ্ণু বা সংবেদনশীল রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে খ্যাত নন। কিন্তু তিনি এটাও জানেন যে, গোটা বিশ্ব তাঁর তামিল-নীতির দিকে নজর রাখছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশনে তাঁর সরকারকে তামিল প্রশ্নে যে ভাবে উপর্যুপরি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ধিক্কৃত হতে হচ্ছে, তাতে দেশের বাইরে তো বটেই, ভিতরেও তাঁর শাসনপ্রণালীর বৈধতা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। স্বেচ্ছায় না হোক, কতকটা বাধ্য হয়েই তাঁকে তামিলদের স্বশাসন দেওয়ার প্রশ্নে আগের অনমনীয় অবস্থান থেকে সরতে হচ্ছে। কিছু দিন আগেও সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী খারিজ করে প্রাদেশিক আত্মশাসনের প্রকল্পটিকে বরাবরের জন্য হিমঘরে পাঠানোর যে উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন, তা থেকে স্পষ্টতই সরে এসেছেন রাজাপক্ষে। তা না হলে তো এই নির্বাচনী কর্মকাণ্ডই সম্ভব হত না। তিনি নিজে এবং তাঁর সরকারের একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী প্রাদেশিক নির্বাচন ও তাতে টিএনএ-র বিপুল সাফল্যকে ‘গণতন্ত্রের জয়’ বলে স্বাগতও জানিয়েছেন। মাংসাশী শ্বাপদ সহসা তৃণভোজী হয়ে যায়, প্রকৃতিতে এমন সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু শিকার যদি কম পড়ে কিংবা অতিরিক্ত ভোজনে যদি অগ্নিমান্দ্য দেখা দেয়, তা হলে মাংসাহারে বীতরাগ জন্মানোও অসম্ভব নয়।
তবে তামিল রাজনীতিকদের কাছে (এবং অবশ্যই সিংহলি রাজনীতিকদের কাছেও) এটা একটা সুবর্ণসুযোগ। পুরনো, যুগবাহিত অবিশ্বাস, সন্দেহ, বিদ্বেষ, এমনকী ঘৃণা সরিয়ে রেখে নতুন করে শুরু করার, পরস্পরের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির কার্যকারণ বুঝে নেওয়ার, পরস্পরের আশঙ্কা, দাবিদাওয়া ও প্রত্যাশা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করার একটা পর্ব আরম্ভ করা যেতেই পারে। অনেক রক্তপাত, অস্ত্রগর্জন, মানববোমা ও ছিন্নমুণ্ডের পরিকীর্ণ পঙ্কশয্যা পেরিয়ে দ্বীপভূমিতে সুচিত হতে পারে এক নতুন প্রত্যূষ। |