প্রবন্ধ ১...
‘স্যর, ওইটুকু ভয়ের জন্যেই তো বেঁচে আছি’
ংকরের লেখা (‘রাজধানী হাওড়ায় সবাই স্বাগত’, ২১-৮) পড়ে মনে পড়ল, সৈয়দ মুজতবা আলি এক জন লেখকের একটি লেখা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন যে, এই লেখাটির ভাব ও ভাষার সঙ্গে তুলনা করা যায় একমাত্র রবীন্দ্রনাথের কাব্যে উপেক্ষিতা-র সঙ্গে। শংকরের লেখাটি পড়ে আমার ওই রকম কতকটা মনে হল, যদিও লেখার বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। হাওড়ার কাছে আমি বিশেষ ভাবে ঋণী। তাই হাওড়ার এই আনন্দের দিনে সেই ঋণের খানিকটা শোধ করতে এই কলম ধরেছি।
আমি পুলিশের যেটুকু কাজকর্ম শিখেছি, তার অনেকটাই চাকরির প্রথম জীবনে হাওড়ায় পোস্টিংয়ের জন্য। অবশ্য হাওড়ায় আমার এস পি, প্রয়াত করালী বোসেরও তাতে অবদান ছিল। ১৯৫৭ সালে হাওড়ায় এ এস পি টাউন হিসেবে পোস্টেড হই। হাওড়ায় তখন এত মিল আর এত বস্তি আর কুলি-লাইন, মনে হত গোটা টাউনটাই যেন একটা কারখানা আর তার সংলগ্ন কুলি-লাইন ও বস্তি।
এস পি-র বাড়ির সামনেই ছিল বার্ন কোম্পানির বিরাট কারখানা, যাতে রেলের জন্যে বছরে আড়াইশো থেকে তিনশো ওয়াগন তৈরি হত। শহরের একটু বাইরের দিকে শিবপুর থানা এলাকার মধ্যেই ছিল গেস্ট কিন উইলিয়মস-এর বিরাট কারখানা। এক বার কারখানার তিন নং ইউনিটে স্ট্রাইক ও গোলমাল হওয়ায় আমাকে কিছু পুলিশ নিয়ে শান্তিরক্ষার জন্যে যেতে হয়। কারখানার চিফ সিকিয়োরিটি অফিসার এক রিটায়ার্ড আর্মি কর্নেল আমার সঙ্গে দেখা করেন ও তাঁরা কত দিন কী ধরনের সাহায্য চান আমায় বলেন। কিছুক্ষণ পর একটু হেসে আমাকে বলেন, জানেন তো, আপনারা জামায় যে সেফটি পিন লাগান, শুধু তা-ই যে এখানে তৈরি হয় তা নয়, এখানে স্ট্রাইক হওয়ায় গোদাবরী নদীতে যে রোড-ব্রিজ হচ্ছে, তার কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু দিন স্ট্রাইক চললে ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট থেকেই আপনাদের ওপরে চাপ আসবে, তাড়াতাড়ি যাতে ওটা মিটে হয়ে যায় তার ব্যবস্থা করতে।

অন্য যুগ, অন্য শহর। ৮ অগস্ট, ১৯৬৭
মালিপাঁচঘড়ার একটা কারখানায় নানা গোলমালের জন্যে মালিকরা সেটিকে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন সব অফিসারদের ঘেরাও করে রাখা হয়েছিল। অনেক রাত্রে আমরা তাঁদের উদ্ধার করে বাইরে নিয়ে যাচ্ছি, তাঁদের মধ্যে এক জন দীর্ঘদেহী খাঁটি ইংরেজ সাহেব ছিলেন, আমার কাঁধে আই পি এস ব্যাজটি দেখে বললেন, ‘আমি আই পি অফিসার ছিলুম। আমার নাম নর্টন জোনস। লালবাজারে ডি সি হেডকোয়ার্টার্স ছিলুম। তুমি নিশ্চয়ই এক দিন লালবাজারে যাবে। তখন ডিসি হেডকোয়ার্টার্সের ঘরে আমার ছবি দেখো।’ পরে লালবাজারে তাঁর ছবি দেখেছি, এখনও যথাস্থানে আছে।
হাওড়ার জুট মিলের অধিকাংশই গঙ্গার ধার দিয়ে, অবশ্য শহরের ভেতর দিকেও কয়েকটি আছে। গঙ্গার ধারে তৈরি হওয়ার এই সুবিধে যে, চটের থলে আর চটের থান, যা বেশির ভাগই রফতানি হয় তা সারি সারি গাধা বোটে চাপিয়ে দেওয়া হত আর একটা লঞ্চের দু’পাশে দুটো করে গাধা বোট বেঁধে ডকের দিকে ছেড়ে দেওয়া হত। জুটের সিজনে তিন শিফটেই কাজ চলত। জুট মিল যাঁরা চালাতেন, সেই সব ম্যানেজারদের প্রায় সকলেরই বাংলোতে বড় বড় লাইব্রেরি দেখেছি।
আর ছিল শহরভর্তি কুলি-লাইন ও বস্তি। শংকর টিকিয়াপাড়া বস্তির নাম করেছেন। সে বস্তির এক পাশে মার্টিন রেলের হাওড়া ময়দান স্টেশন, আর এক পাশে বেলিলিয়াস রোড, উপর দিকে চাঁদমারি ব্রিজ আর মধ্যিখানে টিকিয়াপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি থাকায় বস্তিটা যতটা বাড়তে পারত, ততটা বাড়তে পারেনি। আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় ছিল মালিপাঁচঘড়া থানার ভোটবাগান আর আশপাশের বস্তিগুলো নিয়ে এক বিরাট বস্তি অঞ্চল আর গোলাবাড়ি থানার মধ্যে পিলখানা বস্তি। এ রকম আবর্জনাপূর্ণ দুর্গন্ধময় জায়গা আর কোথাও দেখিনি। অথচ লোকেরা দেখলুম তারই মধ্যে, আনন্দে না হোক, কোনও অভিযোগ না-করে দিনের দিনের পর দিন কাটাচ্ছে। একটা মার্ডার কেসে এক বার কুকুর নিয়ে যেতে হয়েছিল। কুকুর দেখে লোকেদের কী উৎসাহ! কত রকম পরামর্শ আমায় দিল! তার পর যত বার ওখানে গেছি প্রত্যেক বার কত লোক দৌড়ে এসে আমাকে বলত, ‘আপ তো টাউন সাব হ্যায়, উসি রোজ কুত্তা কো লেকে আয়ে থে’। সব কাজে পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েই আছে।
ওই সময়ে হাওড়া টাউনের এক এম এল এ বঙ্কিম কর ছিলেন স্পিকার, আর এক এম এল এ শৈল মুখার্জি ছিলেন অর্থমন্ত্রী। এঁদের এক জনকে জিজ্ঞেস করেছিলুম হাওড়া টাউনের এই অবস্থা, সরকার কিছু করেন না কেন। তিনি বললেন, এখানে জমির দর অত্যন্ত বেশি, ক্রমাগত আরও বাড়ছে। জমি কিনতেই সরকারের সব টাকা চলে যায়।
আমার কোয়ার্টার্স ছিল শিবপুর থানার পাশে। এক দিন রাত্রি ন’টার শোয়ে স্ত্রীকে নিয়ে অলকা সিনেমা হলে ‘চন্দ্রনাথ’ দেখতে গেছি। হাফ টাইমের পরে হঠাৎ শো বন্ধ করে ঘোষণা: ‘এই হলে যদি এ এস পি টাউন নিরুপম সোম থাকেন, তবে তাঁকে বলা হচ্ছে যে, কাসুন্দিয়া লেনে প্রচণ্ড বোমাবাজি হচ্ছে। এস পি তাঁকে অর্ডার দিয়েছেন, এখুনি সেখানে যেতে, যাওয়ার আগে কন্ট্রোল রুম থেকে ডিটেলস জেনে নিতে।’ আমি চিত্রাকে নিয়ে বেরিয়ে এলুম, জিজ্ঞেস করলুম, সে একা বাড়ি ফিরতে পারবে কি না। সে বলল পারবে, আমি তাকে একা রেখে রওনা হলাম। আমার জিপ রাত্রে শিবপুর থানাতেই থাকত। কন্ট্রোল রুম থেকে সব জেনে নিয়ে কাসুন্দিয়া লেনের দিকে রওনা হলুম। বোমাবাজি বন্ধ করে আসামি গ্রেফতার করতে প্রায় ভোর হয়ে গেল। এর মধ্যে শঙ্করীপ্রসাদ (বসু, আমাদের সঙ্গে বাংলায় এম এ’তে প্রথম হয়েছিল) হঠাৎ এসে বলল, সে এই কাসুন্দিতেই থাকে। কথাবার্তা হল। ভোরের দিকে সে আমাদের চা খাওয়াল। হঠাৎ-হঠাৎ রাতবিরেতে এই রকম বেরিয়ে যাওয়া, যে দু’বছর আমি হাওড়ায় ছিলুম, বহু বার হয়েছে। আর হাওড়ায় এই যে কাজ শিখেছিলুম, তার ফলে যখন কলকাতা পুলিশে এলুম, তখন কোনও অসুবিধা হয়নি।
আজকাল যখন কাগজে দেখি প্রায়ই এখানে ওখানে জনতা পুলিশকে মারছে, পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, তখন হাওড়ার বিশেষ করে একটি দিনের কথা খুব মনে পড়ে। ওই দিন বিকেলের দিকে কোনও কাজে বালি থানায় যাচ্ছিলুম। গোলাবাড়ি থানার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, লক্ষ করলুম, গোটা পিলখানা বস্তি একদম সুনসান নিস্তব্ধ। সমস্ত লোক নিজের নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানপাট সব বন্ধ। আমার জিপের ড্রাইভার এক জন লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল যে, বড়বাবু এ বার থানা থেকে বেরোবে। তাই ভয়ে যে যার বাড়ি ঢুকে পড়েছে। আর বড়বাবু কখন বেরোচ্ছে, বেরিয়ে কী করছে, দেখার জন্য বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। পরের দিন গোলাবাড়ি ওসি-র সঙ্গে দেখা। তাঁকে এ ঘটনা বলতে হেসে বললেন, ‘স্যর, ওইটুকু ভয়ের জন্যই তো বেঁচে আছি। নইলে এত বড় পিলখানা বস্তি, এত কলকারখানা, গঙ্গার ঘাট, বিরাট বিরাট এক একটা পাড়া, অর্থমন্ত্রীর মতো লোকেরা থাকেন, হাওড়া ব্রিজের প্রায় ওয়ান-থার্ড, রেল পুলিশের যে দিকটা জেলা পুলিশের আওতায় পড়ে তার সবটা। থানার সাত-আট জন অফিসার নিয়ে চালাতুম কী করে?’ তখন লোকে পুলিশকে ভয় করত আর পুলিশও অহিংস সন্ন্যাসীর মতো চলত না। সে জন্য ল’ অ্যান্ড অর্ডার অনেক ভাল মেনটেনড হত। যখন পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নিচ্ছি, তখন পুলিশের দায়িত্ব একই রকম, কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতাটা অনেক কমে গেছে।
১৯৬৯ সালে আবার হাওড়ায় ফিরে এলুম, এ বার এস পি হয়ে। দেখলুম, হাওড়া প্রায় একই রকম আছে। তফাতের মধ্যে অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষত হাওড়ার গর্বের বিষয় ছোট ছোট রোলিং মিলগুলো প্রায় সবই বন্ধ। বার্ন কোম্পানির রেলের ওয়াগনের অর্ডার বা তারও কম হয়ে গেছে। অনেক জুট মিলেও তালা পড়ে গিয়েছে। শহরের সর্বত্র একটা হতাশা ও বেকারির ছাপ। তবে একটা হাওড়া ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট হয়েছে। তাঁরা চেষ্টা করছেন। অনেক কম ভাড়ায় থাকার ঘর বানিয়েছেন। ডুমুরজলায় একটা স্টেডিয়াম তৈরির প্রস্তাব হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ সব কিছু ছাপিয়ে বন্যার মতো এল নকশাল আন্দোলন। সে অন্য কাহিনি।

কলকাতা পুলিশ কমিশনার (১৯৮০-৮৪)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.