এ কী হল! রায় শুনেই ম্লান মুখ
য়ে ক্যা হো গ্যয়া জি? চাইবাসা ট্রেজারি মামলার রায় শোনার পরে এই ক’টা কথাই বেরিয়ে এল তাঁর মুখ থেকে। তিনি লালুপ্রসাদ যাদব। সকৌতুক রাজনৈতিক টিপ্পনীতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। হাবেভাবে, কথাবার্তায় সব সময়ই অন্যদের থেকে আলাদা। আজ আদালতে ঢোকার মুখেও লালু আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন নিজের মতো থাকতে। কিন্তু রায় ঘোষণা হওয়ার পরে আর পারলেন না। এজলাসে তখন সব চোখ তাঁর উপরে। এজলাসে সেই সময়ে হাজির আইনজীবীরাই পরে জানালেন, সকলের চোখের সামনে ম্লান হয়ে গেল লালুর মুখ। শত চেষ্টাতেও হতাশা চাপতে পারলেন না পোড় খাওয়া রাজনীতিক।

রাঁচির আদালতে এলেন লালু। সোমবার। ছবি: প্রশান্ত মিত্র।
বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। দেশের প্রাক্তন রেলমন্ত্রী। বর্তমান সাংসদ। ফলে লালুর নিরাপত্তার জন্য সকাল থেকেই আদালত চত্বর নিরাপত্তার বেড়াজালে মুড়ে দেওয়া হয়। আদালত-কক্ষ ছোট এই কারণ দেখিয়ে সংবাদমাধ্যমকেও আদালতের বাইরেই আটকে দেওয়া হয়। জেড ক্যাটেগরির নিরাপত্তার ঘেরাটোপে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ আদালত চত্বরে এসে নামেন লালু প্রসাদ। সঙ্গে ছিলেন পুত্র তেজস্বী, দলের বর্ষীয়ান সাংসদ রঘুবংশ প্রসাদ সিংহ, প্রভুনাথ সিংহ প্রমুখ। পরনে সেই সাদা কুর্তা-পাজামা। গাড়ি থেকে নেমেই আদালতের সামনে ভিড় করে থাকা সমর্থকদের উদ্দেশে নিজস্ব ভঙ্গিতেই হাত নাড়েন লালু। আদালত ভবনের বারান্দা পেরিয়ে, আদালতে ঢোকার সময় এক বার পিছন ফেরেন। আবারও হাত নাড়েন। নড়েচড়ে ওঠে জনতা, স্লোগান ওঠে ‘লালু প্রসাদ জিন্দাবাদ’। সপার্ষদ লালু ঢুকে যান বিচারক প্রবাসকুমার সিংহের এজলাসে। ৬৬ বছরের যাদব নেতা কয়েক দিন আগেই কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করতে বলেছিলেন, কারাগার হল কৃষ্ণ ভগবানের জন্মস্থান। আর কৃষ্ণই তো যাদবদের নেতা! তখন থেকেই আশঙ্কা ছিল। তবু এ দিন প্রথমে তাঁকে দেখে মনে হয়েছে, ক্ষীণ আশার খড়কুটো ধরে বদলে ফেলেছেন শরীরী ভাষা। যদিও উত্তেজনা লুকোতে পারছিলেন না লালু-পুত্র তেজস্বী। আদালত বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে ফিসফিস করেছেন, আর ঘন ঘন হাত বুলিয়েছেন দাড়িতে।
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।
লালুর সঙ্গে এ দিন দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন বিহারের তৎকালীন কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশীতিপর বৃদ্ধ জগন্নাথ মিশ্রও। অসুস্থ শরীর। তাই আদালতের সামনের দরজার ভিড় ঠেলে নয়, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় আদালত-কক্ষের পিছন দিকে, বিচারকের ঢোকা-বেরোনোর দরজায়। সেখানে একটি কাঠের চেয়ারে বসে হনুমান চালিশা পড়ছিলেন তিনি। সঙ্কটের মুখে প্রাণপণে ডাকছিলেন সঙ্কটমোচনকে। আর ওষুধ খাচ্ছিলেন মাঝে মাঝে। রায় ঘোষণার পরে জেলে নিয়ে যাওয়ার হলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় তাঁকে রাঁচির রিমস হাসপাতালের ভিআইপি কটেজে ভর্তি করা হয়েছে।
আইনজীবীদের একটি অংশ জানিয়েছে, বিচারক আসার আগে এজলাসে একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে রঘুবংশ, প্রভুনাথ, রাজনীতি প্রসাদ সিংহদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন লালু। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই কখনও মাথার চুল ঠিক করছিলেন। আবার কখনও নাকের ডগায় নেমে আসা চশমা তর্জনী দিয়ে ঠেলে তুলে দিচ্ছিলেন উপরে। তবে দশটা পঞ্চাশ নাগাদ বিচারক আদালত-কক্ষে ঢোকেন। তখন থেকেই যেন ম্লান হতে শুরু করেন আদি ও অকৃত্রিম লালু প্রসাদ। এক সময় চুপচাপ হয়ে যান তিনি। এগারোটা নাগাদ বিচারক প্রবাসকুমার সিংহ সাত ভাগে বিভক্ত মোট চারশো পঁচাত্তর পাতার রায় পড়তে শুরু করেন। আইনজীবীরা কেউ কেউ জানালেন, রায় শুনতে শুনতে এক বার উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েন তিনি। পাশে বসা নেতারা তাঁকে হাত ধরে ফের বসিয়ে দেন।
আতশবাজি পড়ে থাকল গাড়িতেই। লালুপ্রসাদের
বাসভবনের সামনে। সোমবার পটনায়। ছবি: নগেন্দ্রকুমার সিংহ।
বিচারক যখন তাঁর রায়ে অভিযুক্ত সকলকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন এত ক্ষণের নীরবতা ভেঙে পাশে বসা আইনজীবীকে লালু বলেন, “ইয়ে ক্যা হো গ্যয়া জি (এ কী হল)!” সকলের চোখ তখন লালু প্রসাদেই নিবদ্ধ। আইনজীবী তাঁকে কিছু বললেন। লালুর উক্তি, “এ বার দেখুন, হাকিম সাহেব কী সাজা দেন!” ক্ষণিকের জন্য থমকালেন বিচারকও। তাঁর চোখও লালুর দিকে। কিন্তু মুহূর্ত মাত্র। ফের পড়তে লাগলেন রায়। রায় দান শেষ হল। একেবারে ভেঙে না পড়লেও লালুকে যে বেশ হতাশ লাগছিল, তা জানান কোর্টের অন্য আইনজীবীরাও। আত্মবিশ্বাস ফেরাতেই যেন লালু দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বিচারককে বলেন, “বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রয়েছে। আপনাকে আমরা ভগবান বলে মানি। আজ-কালের মধ্যে সাজা ঘোষণা করে দিন। সামনে নবরাত্রি, দুর্গা পুজোও চলে আসছে।” উত্তর দেননি বিচারক। আদালত ভঙ্গ করে উঠে যান ।
কেন আজ বা কাল রায় ঘোষণা চাইছিলেন লালু? আরজেডি নেতারা জানান, কারণ, ৪ অক্টোবর মহালয়ার জন্য আদালত আধ বেলা খোলা। আর ৫ তারিখ থেকে কোর্টে ছুটি পড়ে যাবে। উচ্চ আদালতে আর্জি জানানোর সময় পাওয়া যাবে না। ফলে আরজেডি প্রধানকে নবরাত্রি ও দুর্গা পুজোর সময়টা জেলেই কাটাতে হতে হবে।
রবিবার রাঁচি বিমানবন্দরে নেমে লালু সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আজ রবিবার। আপনারাও বিশ্রাম করুন। জজ সাহেবকেও বিশ্রাম করতে দিন। সোমবার কথা হবে।” কিন্তু রায়ের শেষে, আদালত থেকে বেরিয়ে আজ আর কথা বলেননি তিনি। এর পর উচ্চ আদালতে কবে যাবেন? সাংসদ পদ তো চলে গেল? কেন্দ্রীয় সরকারের অর্ডিন্যান্স প্রসঙ্গে রাহুল গাঁধীর বক্তব্যে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? সংবাদমাধ্যমের এ হেন নানা প্রশ্ন উড়ে যায় তাঁর দিকে। কিন্তু স্পষ্টতই বিরক্তি প্রকাশ করে লালু পুলিশি প্রহরায় গাড়িতে ওঠেন। গন্তব্য এ বার বিরসা মুন্ডা জেল। আদালতে এসেছিলেন লালবাতি জ্বালানো সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরে সেই গাড়িতেই জেলের পথে রওনা দিলেন তিনি। কিন্তু লালবাতি তখন নিভে গিয়েছে।
চাইবাসা ট্রেজারি কেলেঙ্কারি
মামলা নম্বর (আর সি ২০ এ/১৯৯৬)
পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির ৪১টি মামলার অন্যতম।
পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি কী
• অবিভক্ত বিহারের পশুখাদ্য দফতর থেকে ভুয়ো হিসেব দেখিয়ে
মোট ৯৫০ কোটি টাকা তোলা হয়। অভিযুক্ত আর এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগন্নাথ মিশ্রও।
লালু কীসে অভিযুক্ত
• ১৯৯২-’৯৬ সালের মধ্যে চাইবাসা ট্রেজারি থেকে ৩৭ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা তোলা হয়।
সাপ্লায়াররা ছাড়াও একাধিক আমলা, রাজনীতিক অভিযুক্ত।
বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালু তাঁদের অন্যতম।
সিবিআইয়ের তদন্ত
• পুলিশ এফআইআর দায়ের করে ২৭ জানুয়ারি, ’৯৬-এ।
১১ মার্চ তদন্তভার সিবিআইকে। জুলাই, ’৯৭-এ চার্জশিট দাখিল।
লালুর ইস্তফা ও গ্রেফতারি
• ’৯৭-এর ২৫ জুলাই লালুকে ধরতে আধাসেনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ঘিরে ফেলেন সিবিআই জয়েন্ট ডিরেক্টর উপেন বিশ্বাস।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সে দফা গ্রেফতারি এড়ালেও ইস্তফা দেন লালু। মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ী।
পরের মাসে গ্রেফতার লালু। জামিন ১৩৫ দিন পরে।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৩
লালুপ্রসাদ, জগন্নাথ মিশ্র, জেডিইউ সাংসদ জগদীশ শর্মা-সহ ৪৫ জন দোষী সাব্যস্ত।
আট জনের সাজা ঘোষণা। তাঁদের জামিনও। লালু-সহ বাকিদের ৩ অক্টোবর সাজা
শোনানো হবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। লালু আপাতত জেলেই।
এখন কতটা বিপাকে
সম্প্রতি শীর্ষ আদালত ফৌজদারি অপরাধীদের সাংসদ পদ খারিজের নির্দেশ দিয়েছে।
ফলে লালুর সাংসদ পদ খারিজ হতে পারে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.