রায় উস্কে দিল নয়া জোট-অঙ্ক
লালু প্রসাদের কট্টর বিরোধী বিজেপি নেতা সুশীলকুমার মোদী প্রায়ই ঘরোয়া আলোচনায় বলতেন কথাটা “লালু প্রসাদের মতো মনের জোর এ দেশে খুব কম নেতার আছে। অন্য যে কোনও নেতার মাথায় পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির দায় চাপলে তিনি রাজনীতি থেকে উবে যেতেন। লালু কিন্তু তার পরেও একই রকম দাপটে রাজনীতি করছেন। এটাই লালুর বৈশিষ্ট্য। রাজনীতির ময়দানে অফ-ফর্ম কাটিয়ে তিনি ফিরে আসতে জানেন।”
কিন্তু আজ রাঁচিতে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত লালু প্রসাদকে পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করার পরে বিহারে তো বটেই, তাঁর প্রত্যাবর্তন নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে জাতীয় রাজনীতিতেও। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে ২ বছরের বেশি সাজা হলেই লালুকে ছাড়তে হবে সাংসদ পদ। শুধু তা-ই নয়, আগামী পাঁচ বছর ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না তিনি। অর্থাৎ, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোট হতে চলেছে লালুকে ছাড়াই। এই পরিস্থিতিতে দু’টি প্রশ্ন সকলকে ভাবাচ্ছে। এক, আরজেডি-র হাল এর পরে কে ধরবেন? যিনিই ধরুন না কেন, তিনি কি পারবেন যাদব ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখতে? আর দুই, কংগ্রেসের সঙ্গে লালুর দলের সম্পর্ক কী দাঁড়াবে? সনিয়ার দল কি এ বারে নতুন শরিক ও সমীকরণের খোঁজে ময়দানে নামবে? এগুলির জবাব খুঁজতে গিয়ে অনেক জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছে রাজনীতিকদের মধ্যে। এবং সেই জল্পনাগুলি একে অন্যের সঙ্গে ভীষণ ভাবে যুক্ত।
আদালত চত্বরে লালু প্রসাদের ছেলে তেজস্বী। সোমবার।
সব মিলিয়ে, আজকের একটি রায় বিহার তো বটেই, জাতীয় ক্ষেত্রেও অজস্র সম্ভাবনার দরজা খুলে দিল। ১৭ বছর আগে জুলাইয়ে লালু-সহ একাধিক রাজনীতিক ও আমলার নামে যখন চার্জশিট পেশ করেছিল সিবিআই, বিহারের রাজনীতিতে তখনই আরও একটি ঘটনা ঘটছে। নীতীশ কুমার জোট বাঁধছেন বিজেপির সঙ্গে। সেই জোট এই সবে, গত জুন মাসে ভেঙে গিয়েছে। তার পর থেকে নীতীশের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল হচ্ছে কংগ্রেসের। একাধিক ঘটনায় সেই ইঙ্গিত মিলেছে। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৈরি তালিকায় বিহারকে সব থেকে পিছিয়ে পড়া রাজ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। ফলে নীতীশকে বিশেষ আর্থিক সাহায্য দেওয়ার দরজাও খুলে গিয়েছে কেন্দ্রের সামনে। তেমনই আবার জেপিসি-র রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সাহায্য করেছে জেডিইউ। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে, জেডিইউ নেতা শিবানন্দ তিওয়ারি আজ বলেছেন, “রাজনীতি যে দিকে যাচ্ছে তাতে তো কংগ্রেস এবং জেডিইউ-এর জোটের সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়ছে।”
আরজেডি নেতৃত্বের একাংশও এ দিন রায় শোনার পরে ফেটে পড়েছেন কংগ্রেস-জেডিইউয়ের বিরুদ্ধে। বৈশালির সাংসদ তথা আরজেডি নেতা রঘুবংশ প্রসাদ তো লালুর গ্রেফতারিকে কংগ্রেসের চক্রান্ত বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে লালুর দলের বিরোধ বাড়াতে ময়দানে নেমে পড়েছে বিজেপিও। যে ছপরা কেন্দ্রের সাংসদ লালু, সেখান থেকেই লোকসভা ভোটে লড়বেন বিজেপির রাজীবপ্রতাপ রুডি। আরজেডি-র একাংশের অভিযোগকে সমর্থন করে তাঁর বক্তব্য, “কংগ্রেস ও নীতীশ মিলেই ওই (লালুকে জেলে পাঠানোর) ষড়যন্ত্র করেছে।”

কোর্টের এই রায় নিয়ে
আমি কোনও রকম
মন্তব্য করতে চাই না।


উনি দোষী নন।
মুখমন্ত্রী কখনও রাজকোষ লুঠ করে?
বিচার চাইতে জনতার আদালতে যাব।



রাজকোষ লুঠ করার
খেসারত দিচ্ছেন লালু প্রসাদ।
দোষ করলে শাস্তি পেতেই হবে।


আমরা হাইকোর্টে আবেদন করব।
বিচার ব্যবস্থায় পূর্ণ আস্থা রয়েছে।

(লালু প্রসাদের ছেলে)

লালুজির জেল হয়েছে শুনলাম।
এক দিনের জন্যও লোভ করতে নেই।
তা হলে কালকের দিন ভাল যাবে না।


আমরা আদালতের রায় মেনে নিই। এখন নেতাদের
বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
আমরা এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।

লালুকে কি সত্যিই দূরে ঠেলতে চাইছে কংগ্রেস? এ নিয়ে ইউপিএ-র প্রধান দল আপাতত দ্বিধা বিভক্ত। এক দিকে, সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে লালু প্রসাদের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক রয়েছে। ইউপিএ-র শেষ নৈশভোজেও সনিয়া নিজে লালুকে রাহুলের পাশে বসিয়ে দিয়েছিলেন। এ বার তিনি কী অবস্থান নেন সে দিকে তাকিয়ে অনেকেই। অন্য দিকে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ শুরু করা রাহুল গাঁধী যাদব কুলপতির প্রতি কী মনোভাব নেন, তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করছে। শুক্রবার দিল্লি প্রেস ক্লাবে ঝোড়ো মিনিট পাঁচেকের ইনিংসে তিনি যে ভাবে মনমোহন সিংহ সরকারের আনা অর্ডিন্যান্সকে (সুপ্রিম কোর্টের রায় এড়াতে দু’বছর বা তার থেকে বেশি মেয়াদের সাজাপ্রাপ্ত সাংসদ-বিধায়কদের বাঁচাতে যে অর্ডিন্যান্স আনা হচ্ছিল) ‘ফালতু’ বলে বর্ণনা করেছেন, সেটি ছিঁড়ে উড়িয়ে দিতে বলেছেন, তাতে আরজেডি-র সঙ্গে জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট নয়। এই অবস্থায় এআইসিসি-র একাধিক সদস্য বলতে শুরু করেছেন, জোট হলে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নীতীশের সঙ্গেই করা উচিত।
কিন্তু নীতীশের সঙ্গে জোট নিয়েও কংগ্রেসের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সেই দলে রয়েছেন রাহুল-ঘনিষ্ঠ দিগ্বিজয় সিংহও। তিনি আজ বলেন, “আমার মনে হয় লালু প্রসাদকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি আশা করছি উচ্চ আদালতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে সক্ষম হবেন তিনি।” ওই অংশের মতে, লালু সর্বদা ইউপিএ সরকারের পাশে থেকেছেন। ফলে এত দ্রুত তাঁকে বাতিল করে দেওয়া ঠিক নয়। তা ছাড়া রাজ্য নেতৃত্বও ইতিমধ্যেই কংগ্রেস হাইকম্যান্ডকে জানিয়েছেন, তাঁরা নীতীশের বদলে লালুর সঙ্গে জোট বাঁধতে চান। তাঁদের যুক্তি, নীতীশের সঙ্গে জোট করতে গেলে তাঁর শর্ত মাথা পেতে নিতে হবে।
এই মামলায়
• মোট অভিযুক্ত
• বিচার চলাকালীন
• রাজসাক্ষী
• সাজাপ্রাপ্ত
• বিচারে মুক্ত
• অভিযুক্ত ছিল
• সাক্ষী:
৫৬
মৃত ৭



৪৫
৩৫০ (সরকার পক্ষ), ৩২ (আসামি পক্ষ)
কোন ধারায় মামলা
• ১২০বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র)
• ৪২০ (প্রতারণা)
• ৪৬৭ (মূল্যবান সম্পদ দখলে জালিয়াতি)
• ৪৬৮ (প্রতারণার জন্য জালিয়াতি)
• ৪৭৭এ (প্রমাণ লোপাট/ প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা)
• দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৮৮
তা ছাড়া, আট বছর ক্ষমতায় থাকার পরে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়ায় বিহারে নীতীশের পায়ের তলা থেকে জমি সরতে শুরু করেছে। এবং নতুন করে শক্তি সংগ্রহ করে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে আরজেডি। আজকের ঘটনার পরে লালু ফের সহানুভূতির হাওয়ায় যাদব ভোটব্যাঙ্ক সংগঠিত করতে পারবেন বলেও তাঁদের বিশ্বাস। একই সঙ্গে তাঁরা মনে করেন, কংগ্রেস-লালু জোট সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের একটা বড় অংশ নিজেদের ঝুলিতে আনতে পারবে। আরজেডি-র পক্ষে দাঁড়িয়ে বিহারের এক সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতা এ-ও বলেছেন, “কোনও দলের এক জন নেতা দোষী সাব্যস্ত হলে কি আর সেই দলের সঙ্গে কোনও দিন জোট হবে না! জোটের পরিস্থিতি তৈরি হলে আমরা তেজস্বীর (লালু প্রসাদের ছেলে) সঙ্গে হাত মেলাব।” আরজেডি-র ভিতরে-বাইরে অনেকেই আবার বলছেন, উচ্চ আদালতে লালু যদি জামিন পেয়ে যান, তা হলে তো তিনিই মাঠে থাকবেন। তখন আরজেডি-র নেতৃত্ব সঙ্কট নিয়ে প্রশ্নের কোনও অবকাশ থাকবে না।
কিন্তু তা না পেলে? এখানেই উঠেছে কোটি টাকার প্রশ্ন আরজেডি-তে লালুর পরে কে? বস্তুত, লালু কতটা স্বমহিমায় ফিরতে পারবেন এবং কবে ফিরতে পারবেন, তা নিয়ে আরজেডি-র অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে। দলের এক নেতার কথায়, “পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি যখন সামনে আসে, তখন লালুজির বয়স ছিল পঞ্চাশেরও কম। রাজ্য রাজনীতিতেও তখন তিনি স্বমহিমায়। যাদব-মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক পুরোটাই তাঁর ঝুলিতে।” কিন্তু এখন? তাঁর মতে, “লালুজির বয়স এখন ৬৬। তা ছাড়া ২০০৫ সালের পর থেকে লাগাতার হারে বিপর্যস্ত। এই লালুর পক্ষে ফেরা কঠিন।”
তা হলে? আরজেডি নেতা রামকৃপাল যাদব বলেন, “লালু জেলে থাকলে দল পরিচালনায় কোর কমিটি তৈরি হবে।” আরজেডি সূত্রের খবর, এই কোর কমিটিতে রামকৃপাল ছাড়া আরও পাঁচ জনের নাম প্রাথমিক ভাবে উঠে এসেছে। তাতে ছেলে তেজস্বী ছাড়াও রয়েছেন লালুর স্ত্রী তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ী দেবী। আছেন, রাজপুত নেতা রঘুবংশপ্রসাদ সিংহ, সংখ্যালঘু নেতা আব্দুল বারি সিদ্দিকি ও অত্যন্ত পিছড়েবর্গের নেতা রামচন্দ্র পূর্বে।
তবে লালু-ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, কোর কমিটি হলেও দলের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে লালুর পছন্দ তেজস্বীই। তিনি চান না দলের রাশ পরিবারের বাইরে চলে যাক। রাবড়ী দেবীও বলেছেন, “সনিয়া এবং রাহুল গাঁধী কি কংগ্রেসকে চালাচ্ছেন না! আমরাও সে ভাবে আরজেডি-কে চালাব।” দলের এক নেতার কথায়, জেলে যেতে হতে পারে ধরে নিয়ে তিন-চার মাস আগে থেকেই তেজস্বীকে নিয়ে রাজ্যের নানা জায়গায় ঘুরতে শুরু করেছিলেন লালু।
উল্টো মতও রয়েছে। আরজেডি নেতৃত্বেরই একাংশ মনে করছেন, পরিবারের হাতে ক্ষমতা ধরে রাখলে আখেরে লালুরই ক্ষতি হবে। দলও ভাঙবে। সে ক্ষেত্রে অনেক নেতার দল ছাড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা। এর মধ্যেই অক্টোবরে বিহারে নরেন্দ্র মোদীর আসার কথা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মোদীকে ঘিরে যে উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে, বিহাররও তার থেকে বাদ যাবে না বলে আশা বিজেপির। রাজ্য বিজেপির একাংশের ধারণা, তেজস্বী নেতা হলে লালুর যাদব ভোটে ভাগ বসাতে পারবেন পিছড়ে বর্গের নেতা নরেন্দ্র মোদী। লালুর ভাগের অল্প উচ্চবর্ণের ভোটও চলে আসবে তাঁদের ঝুলিতে।
প্রকাশ্যে না বললেও মোদী-ঝড়ের আশঙ্কা অনেক নেতারই রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু তো বটেই, তার সঙ্গে যাদব, দলিত, কুর্মি ভোট একজোট রাখা যায় কী ভাবে, তা নিয়েও কেউ কেউ চিন্তায়। রামবিলাস পাসোয়ান যেমন বলেই দিয়েছেন, তিনি লালুর সঙ্গ ছাড়ছেন না। বাকি রইল কংগ্রেস ও জেডিইউ। নীতীশের দল এ দিন মুখ খোলেনি। কংগ্রেসও ইঙ্গিত দেয়নি, কোন পথে তাঁরা এগোতে চান। তবে কোনও কোনও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, মোদীর ভয়ে আগামী লোকসভা ভোটে যদি লালু, কংগ্রেস, নীতীশ এবং রামবিলাস হাত মেলান, তা হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এক সময়ের সহযোদ্ধা এবং এখন সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী নীতীশের সঙ্গে লালুর জোট? হাসতে হাসতে কেউ কেউ বলছেন, মোদী-ঝড়ের সামনে কিছুই এখন আর অসম্ভব নয়।

সহ-প্রতিবেদন: অনমিত্র সেনগুপ্ত
ছবি: প্রশান্ত মিত্র।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.