দাদু যদি জানতেন! তা হলে হয়তো বেঁচেবর্তে থেকে বই লেখার সুযোগটাই পেতেন না জার্মান-নাইজেরীয় লেখিকা জেনিফার টিগে।
কারণ জেনিফারের দাদু ছিল কসাই! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাৎসি অধিকৃত পোল্যান্ডের প্লাসজো কনসেনট্রেশন
|
আমন গ্যেট |
|
জেনিফার টিগে |
ক্যাম্পের কম্যান্ডাট আমন গ্যেট কসাই বলেই পরিচিত। নিজের ‘কলঙ্কিত’ অতীত-স্মৃতি খুঁড়ে বার করতে গিয়ে তাই গায়ে কাঁটা দিয়েছিল জেনিফারের। সেই যন্ত্রণা থেকেই লিখে ফেলেন, ‘আমন: মাই গ্র্যান্ডফাদার উড হ্যাভ শট মি’ বইটি।
যেখানে জেনিফার বলছেন, তাঁর জন্মপরিচয় জানতে পারলে দাদু তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলত। লেখিকা দাদুর কীর্তিকলাপ জানার পরেই এই মন্তব্য করেছেন। ইহুদিদের যতটা নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করত রক্তপিপাসু মানুষটি, সে যদি জানত তার নাতনি কৃষ্ণাঙ্গ, তা হলে হয়তো জেনিফারকে ‘মনুষ্যেতর জীব’ ছাড়া কিছু ভাবতেই পারত না।
প্লাসজো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদিদের দুর্দশার সীমা ছিল না গ্যেটের জন্য। স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ ছবিতে গ্যেটের চরিত্রেই দেখা গিয়েছিল রাল্ফ ফিয়েনেসকে। শুধুমাত্র মজা পাওয়ার জন্য যে বন্দিদের পর পর গুলি করে মারত। পাহারাদার কুকুর কী ভাবে ছিঁড়েখুড়ে ফেলছে অসহায় মানুষগুলোকে মদ খেতে খেতে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত সেই দৃশ্য। ১৯৪৬ সালে যুদ্ধাপরাধে গ্যেটের ফাঁসি ঘোষণা করা হয়। জীবনের শেষ মুহূর্তেও নাৎসি বাহিনীর প্রতি অনুগত ছিল সে।
এক নাইজেরীয় ছাত্রের সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল জেনিফারের মা মনিকার। জন্মের কিছু দিনের মধ্যেই অবশ্য জেনিফারকে দত্তক নিয়েছিল মিউনিখের একটি অভিজাত পরিবার। পরবর্তীকালে মায়ের লেখা একটি বই হাতে আসে জেনিফারের। যা থেকে তিনি জানতে পারেন প্লাসজোয়ের কসাইয়ের কথা। তার পরেই নিজের অতীত সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী হন জেনিফার। তাঁর কথায়, “মনে হল পায়ের নীচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। দাঁড়াতে পারছিলাম না। স্বামীকে বললাম আমি গাড়ি চালাতে পারব না, আমাকে নিয়ে যাও।” ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ দেখেছেন জেনিফার। কিন্তু তিনি জানতেন না, সেটার সঙ্গে নিজের অতীতের কোনও সম্পর্ক রয়েছে। ছবিতে রয়েছে প্লাসজোয়ের এক জার্মান ব্যবসায়ীর গল্প। যুদ্ধের সময় যিনি তাঁর অধীনে কাজ করতেন যে সব ইহুদি, তাঁদের বিভিন্ন কৌশলে রক্ষা করতেন।
দুই সন্তানের জননী জেনিফার দাদুর সঙ্গে দেখা না পেলেও দেখা হয়েছে তাঁর ঠাকুরমার সঙ্গে। রুথ নামের ওই মহিলা ছিলেন আমন গ্যেটের প্রাক্তন সেক্রেটারি। ১৯৪৫-এ যিনি জন্ম দেন জেনিফারের মা, মনিকাকে। এর পরে অতীতের এক একটি অধ্যায় ছবির মতো ভেসে ওঠে জেনিফারের চোখে। তিনি প্লাসজোয়ের ধ্বংসস্তূপ দেখতে যান। দেখতে পান সেই বাড়িটা, যেখান থেকে তাঁর দাদু এক সময়ে নিয়ন্ত্রণ করত অসংখ্য মানুষের জীবন-মরণ।
জেনিফারের মা মনিকা তাঁর নিজের মায়ের সঙ্গে থাকেন না। ২০১০ সালে ইজরায়েলি একটি তথ্যচিত্রের জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে পৌঁছে যান প্লাসজোয়ের সেই বাড়িতে। মনিকা বলেন, “কোলে শিশু নিয়ে পর পর মহিলারা দাঁড়িয়ে আছেন। আর এই বারান্দা থেকে আমার নাৎসি বাবা তাঁদের গুলি করে মারছে। আমি সেই লোকটার মেয়ে! এই যন্ত্রণা আমায় কুরে কুরে খায়।” জেনিফারও বলছেন, “মা তাঁর নিজের ইতিহাস কিছুতেই মানতে পারেন না। আমাকে সেই নিষ্ঠুর অতীত থেকে আপ্রাণ আড়াল করার চেষ্টা করতেন।” কিন্তু জেনিফার যখন ঘটনাচক্রে অতীত জেনে ফেলেন, তখন নিজেই ঠিক করেছিলেন, তা প্রকাশ্যে আনবেন। তাঁর কথায়, “অতীত নিয়ে কারুর অপরাধবোধ থাকলে তাঁরা আমার এই কাহিনি থেকে অনুপ্রেরণা পেতে পারেন।” |