কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি ক্যানসার-রোগিণীর এ পজিটিভ রক্ত দরকার! দিন কয়েক আগে ডাক্তারের নম্বর-সহ এই টুইট করেছেন স্বয়ং যুবরাজ সিংহ। কে বলে শুধুই জাতীয় দলে ফিরতে মরিয়া তিনি? চ্যালেঞ্জার ট্রফিতে ঝোড়ো ইনিংস খেলার ফাঁকেও ক্যানসার-আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াতে যুবি ঠিক সময় করে নিচ্ছেন!
মনীষা কৈরালার টুইটেও এখন ঘুরে-ফিরে ক্যানসার-সচেতনতার বার্তা। ‘আমি হলাম ক্যানসার-ক্রুসেডার বা ক্যানসার-যোদ্ধা।’ লিখেছেন তিনি। বলিউড অভিনেত্রী নিজেকে কখনওই নিছক ‘ক্যানসার থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা এক জন’ হিসেবে দেখতে চান না।
‘বাবুমশাই, জিন্দগি লম্বি নহি, বড়ি হোনি চাহিয়ে!’ রাজেশ খন্না, থুড়ি ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত ‘আনন্দ’-এর কবেকার সেই হিট সংলাপ এখনও মুখে-মুখে ঘোরে। যুবি আর মনীষা— দুই তারকার জীবনদর্শনও পাল্টে দিয়েছে ক্যানসার। ওঁরা সমাজকে জানাতে চাইছেন, ক্যানসারের কবলে পড়লেও সঠিক চিকিৎসায় জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত প্রাণ ভরে বাঁচা সম্ভব। যদি না হারের আগেই কেউ হার স্বীকার করে বসেন। আবার আধুনিক চিকিৎসা বলে, ঠিক সময়ে সতর্ক হলে ক্যানসারকে এমনকী ঘায়েল করাও মোটে অসম্ভব নয়। তখন জীবনের মান ও দীর্ঘ জীবন— দু’টোই আসতে পারে হাতের মুঠোয়।
এবং এই বার্তা তথা সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে একদা ক্যানসারের সঙ্গে বসবাসকারী মানুষজনই সমাজের বড় হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারেন বলে মনে করছেন শহরের ক্যানসার-বিশেষজ্ঞেরা। যেমন রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্ট শৈবাল মুখোপাধ্যায়ের আফশোস, “সচেতনতার খামতিতেই ভারতে ক্যানসারের প্রকোপ এমন মারাত্মক চেহারা নিয়েছে। এ দেশে শতকরা ৭৫ ভাগ ক্যানসার রোগী ডাক্তারের কাছে আসেন রোগটা অনেক দূর ছড়িয়ে যাওয়ার পরে। অথচ আমেরিকায় ঠিক এর উল্টো!” |
ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “যাঁরা নিজেরা ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, তাঁরা সচেতনতা প্রসারের কাজে নামলে অবশ্যই আলাদা প্রভাব পড়বে।”
ক্যানসার-সচেতনতার প্রচারে যুবরাজ ও মনীষার এ ভাবে এগিয়ে আসাকে যথেষ্ট ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবে দেখছেন চিকিৎসকেরা। আর যুবরাজ-মনীষার মতো তারকা এখন যা বলছেন, সেটাই বলে চলেছেন কলকাতার তাপস রাহা বা সোমাশ্রী রায়। রয়েছেন কবিতা সেনগুপ্ত, সিতাংশুশেখর দাস মহাপাত্রের মতো মানুষ। কী রকম?
মস্তিষ্কের ক্যানসারে আক্রান্ত তাপসবাবুকে চিকিৎসকেরা কার্যত জবাব দিয়েছিলেন। বলে দিয়েছিলেন, জীবনের মেয়াদ ছ’মাস, বড়জোর এক বছর। পাঁচ বছর সাত মাস গড়িয়ে গিয়েছে। গড়িয়াহাটের সেই লোকই একা-একা মুম্বই-চেন্নাই করেছেন। মস্তিষ্কে গ্রেড ফোর টিউমার নিয়েও হার মানতে রাজি হননি ষাটোর্ধ্ব তরুণ। অস্ত্রোপচার, ওষুধে ভরসা রেখে ডাক্তারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। বার বার এমআরআই করে দেখা যাচ্ছে, তাপসবাবুর টিউমার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
ক্যানসারের আকস্মিক আক্রমণে অসহায় রোগীদের অনেকের কাছে এখন মূর্তিমান ভরসা এই তাপস রাহা। যিনি অসুখের কামড়ে ডান হাতে বিশেষ লিখতে পারেন না। বাঁ হাতেই স্মার্টফোনে দেশ-বিদেশের ডাক্তার-রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। ব্যবসার কাজ সামলে বেশ কয়েক জন ক্যানসার রোগীর পরামর্শদাতা তথা কেয়ার-গিভার হিসেবে যিনি ব্যস্ত। আর যাঁর সাহস দেখে এ দেশের তো বটেই, জার্মানি-আমেরিকার অনেক ডাক্তারও মুগ্ধ। ওঁর নিজের কথায়, “ক’বছর বাঁচব, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমি আমার কাজটুকু করে যাচ্ছি।”
সন্তোষপুরের সোমাশ্রী রায়েরও নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। স্তন ক্যানসারের প্রায় স্টেজ-থ্রি থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই মহিলা আপাতত গাঁয়ে-গঞ্জে ছুটে বেড়াচ্ছেন, ক্যানসার-সচেতনতার শিবিরে শিবিরে। চেষ্টা করছেন মফস্সলে ক্যানসার-আক্রান্তদের জন্য সেবাসদন গড়ে তুলতে। আর জোর গলায় বলছেন, “ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ক্যানসারের মাধ্যমে এ ভাবে জীবন নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গিটাই বদলে দেওয়ার জন্য। অন্যের জীবনও এখন আমার কাছে অনেক বেশি দামি।”
গড়িয়ার কবিতা সেনগুপ্তের কাহিনীও সিনেমার মতো রোমহর্ষক। ছেলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ক’দিন আগে ডাক্তারেরা বলে দিলেন অবিলম্বে অপারেশন করাতে। স্তন ক্যানসার। মুখচোরা ভীতু মহিলা এমনিতে জোরে বাজ পড়লেও ভয়ে কাঁপেন। তখন মাথার উপরে কোনও অভিভাবক নেই। তবু কঠিন অসুখের টেনশন পরীক্ষার্থী ছেলের সঙ্গে ভাগ করতে চাননি। ছেলের পরীক্ষা শেষ হওয়ার দু’দিনের মধ্যে অস্ত্রোপচার করিয়েছিলেন। বছর পাঁচেক বাদে পুরোপুরি সুস্থ।
এ হেন এক জন যে অন্য জনকেও জীবনের ভরসা জোগাবেন, তাতে আশ্চর্য কী? এই মুহূর্তে কবিতাদেবী অবশ্য বেজায় ব্যস্ত কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার পুত্রের আসন্ন বিয়ে উপলক্ষে। তাঁর মতো দিব্যি আছেন ছেষট্টি বছরের সিতাংশুশেখর দাস মহাপাত্র। এক বছর আগে যিনি প্রায় সব ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলেন। জানতে পেরেছিলেন, কোলনের ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ছে লিভারে। জীবনবিমা নিগমের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার জানাচ্ছেন, “জীবনভর শৃঙ্খলা মেনে চলেও ক্যানসার হল ভেবে প্রথমে খুব খারাপ লাগছিল। পরে ঠিক করলাম, এত সহজে হাল ছাড়ব না।” ডাক্তারের কথা মেনে প্রায় সুস্থ সিতাংশুবাবু নিউটাউনের ফ্ল্যাটে ইদানীং ফের প্রাণায়াম শুরু করেছেন। বেরোচ্ছেন প্রাতর্ভ্রমণে। গোগ্রাসে পড়ছেন প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র।
কাল, মঙ্গলবার শহরের এক পাঁচতারা হোটেলের বলরুমে কলকাতার এমন কয়েকটি চরিত্রের সঙ্গে হয়তো দেখা হবে যুবরাজ ও মনীষার। “ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইটা জোরালো করতেই দুই তারকা ক্যানসারজয়ীকে এক মঞ্চে আনা হচ্ছে।”—বললেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। অনুষ্ঠানটির আয়োজকদের মধ্যে ঋতুপর্ণার নিজস্ব সংগঠন ছাড়াও রয়েছে তাঁর বন্ধু সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সংস্থা। সুব্রতবাবু এখানেই থামতে চান না। তাঁর ইচ্ছে, সমাজের সকলকে নিয়ে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইটা জারি রাখার। নিউ ইয়র্কে বন্ধু মনীষাকে দেখতে গিয়ে তাঁর ইতিবাচক মনের ছোঁয়ায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন ঋতু। তখনই ইচ্ছে হয়, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েও হারতে নারাজ মানুষগুলোকে নিয়ে কিছু একটা করার।
আজকের ক্যানসারজয়ীরা অনেকেই যে অন্য ভাবে জীবনের চিত্রনাট্য লিখছেন!
|