সন্ত্রাসের জন্য বারবার সংবাদ শিরোনামে এসেছে মঙ্গলকোট। এ বার ব্যতিক্রম। সন্ত্রাস নয়। মঙ্গলকোটে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন প্রত্ন সংগ্রহ করে একটি প্রত্ন সংগ্রহশালা গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে রাজ্য প্রত্ন দফতর। এই প্রয়াস শুরু হয়েছে আড়াই বছর আগে থেকে।
২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলকোটের প্রাক্তন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি রেণুকা সর রাজ্যের প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহশালার অধিকর্তাকে চিঠি দিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, এলাকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও সামগ্রী রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে। সেই সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী সংগ্রহ করে রাখা হোক প্রত্নশালায়। তার জন্য নতুনহাটে অবস্থিত মঙ্গলকোট ব্লক দফতরের ভিতর জমি দেওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
এর আগে মঙ্গলকোটে সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক সাধনা মল্লিক ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ-এর (এএসআই) অধিকর্তাদের চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ওই চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৭০ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় মঙ্গলকোট থেকে প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ করেছিল। ১৯৭৫ সালে কলকাতার প্রত্ন বিভাগ মঙ্গলকোটে গবেষণা করেছে। রাজ্য প্রত্ন দফতরের উপ-অধিকর্তা অমল রায় বলেন, “২০০৬ সাল পর্যন্ত মঙ্গলকোটে বহু বার গবেষণার জন্য এসেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা (আর্কেওলজিক্যাল রিসার্চ)। ১৯৮৬ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজ্য প্রত্ন দফতর, কাস্ট-এর (সেন্টার ফর আর্কেওলজিক্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড ট্রেনিং) সদস্যেরা বার বার মঙ্গলকোটে খনন কার্য চালিয়েছে। মিলেছে মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত যুগের ইতিহাস।” এই খনন কার্যের উদ্দেশ্য ছিল মূলত মঙ্গলকোটে বসতি কবে শুরু হয়েছে এবং কবে শেষ হয়েছে তা নির্ণয় করা। অমলবাবু আরও বলেন, “দক্ষিণবঙ্গে যে সমস্ত প্রত্নস্থল রয়েছে, তার মধ্যে মঙ্গলকোট হল একটি উল্লেখযোগ্য প্রত্নস্থল।” |
ইতিহাস সন্ধিৎসু মানুষেরা জানাচ্ছেন, প্রাচীন মঙ্গলকোটের মানুষের গোলা-বারুদের সঙ্গে পরিচিতি ছিল না। প্রাচীন মঙ্গলকোটে ছিল সমৃদ্ধি। এখনও মঙ্গলকোটে রয়ে গিয়েছে গুপ্ত-কুষাণ যুগের চিহ্ন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রাচীন মূর্তি, টেরাকোটার পাত্র, তাম্রশ্মীয় যুগের মুদ্রা। মঙ্গলকোটের বিক্রমাদিত্যের ডাঙা (সরকারি ডাঙা), মনুমিঞার ডাঙা, কচুরিডাঙা, কুনুর নদীর তীরবর্তী এলাকা থেকে মিলেছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মঙ্গলকোটের জহরপুর থেকে পাওয়া গিয়েছে চারটি মূর্তি। যার মধ্যে রয়েছে ২ কুইন্টাল ওজনের কষ্টি পাথরের মূর্তি। কুবেরের মূর্তিও আছে। কুনুর নদীর তির থেকে নৃসিংহ মূর্তি মিলেছে। খ্রিস্টীয় নবম-দশকের নৃসিংহ মূর্তিটি বিরল বলে দাবি প্রত্নতাত্ত্বিকদের। এই সব মূর্তি ছাড়াও মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রাম মা যোগাদ্যা বিদ্যাপীঠ থেকে শুরু করে বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কুষাণ-পাল যুগের নানা মূর্তি। বর্তমানে এই সমস্ত মূর্তি রয়েছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজ্য প্রত্নশালায়।
অমলবাবুর বক্তব্য, “মঙ্গলকোটে প্রত্ন সংগ্রহশালার জন্য ২ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা অনুমোদন হয়েছে। টেকনিক্যাল কিছু কাজ বাকি রয়েছে। তারপরই প্রত্ন সংগ্রহশালার কাজ শুরু হবে।” তিনি আরও জানান, মঙ্গলকোটে ছড়িয়ে থাকা মুঘল, সুলতানি যুগের স্থাপত্য কীর্তি এক জায়গায় সংগ্রহ করে প্রত্নশালা গড়ে উঠলে জনসাধারাণের স্পষ্ট ধারণা হবে এই জায়গাটির সম্বন্ধে। প্রত্ন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলকোট ছাড়াও চন্দ্রকেতুগড়ে ২ কোটি, দাঁতনে ৭৫ লক্ষ টাকা খরচ করে প্রত্ন সংগ্রহশালা তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। এর মধ্যে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ইতিহাস সমৃদ্ধ জগজ্জীবনপুর (ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা, মালদা জেলায় অবস্থিত) গ্রামে প্রত্ন সংগ্রহশালা তৈরির ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ হয়ে গিয়েছে। দফতর সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, মঙ্গলকোটে প্রত্ন সংগ্রহশালা তৈরি ছাড়াও বর্ধমান জেলার মানকর, কাটোয়ার শ্রীবাটি, জামালপুরের সুবলদহতে প্রাচীন সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য মন্দির ও স্তম্ভ সংস্কার করবে প্রত্ন দফতর। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের অনুমোদনও তাঁরা পেয়ে গিয়েছে।
অতীতে যে সব মূর্তি পাওয়া গিয়েছে মঙ্গলকোট থেকে, সে সব মূর্তির খোঁজ রাখেন ইতিহাস প্রত্নসন্ধিৎসু কেশব বন্দ্যোপাধ্যায়। স্থানীয় এই বাসিন্দা বছরের পর বছর ধরে মঙ্গলকোটের অজয়-কুনুর নদীর ধার থেকে মূর্তি সংগ্রহ করে কখনও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় বা কখনও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছেন। কেশববাবুর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, মঙ্গলকোটে একটি প্রত্ন সংগ্রহশালা গড়ে উঠুক। তা গড়ে উঠলে পর্যটকেরা এবং গবেষকেরা মঙ্গলকোট এবং সংলগ্ন এলাকার সম্বন্ধে জানতে পারবেন।
কেশববাবুর কথায়, “প্রত্নশালা হলে ওই সব মূতির্ মঙ্গলকোটে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া বেহালাতেও আমাদের এলাকার প্রচুর মূর্তি রয়েছে। সেগুলিকেও ফিরিয়ে আনতে হবে।” |