শেষ পর্যন্ত রাজ্যসভার সাংসদ কুণাল ঘোষকে সাসপেন্ডই করল তৃণমূল। দলবিরোধী মন্তব্য করার অভিযোগে তাঁকে আগেই শো-কজ করা হয়েছিল। এ বার তাঁকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে বলে তৃণমূলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় শনিবার ঘোষণা করেন। শাস্তির কথা জেনে কুণালের মন্তব্য, “দলকে হেয় বা অসম্মান করে কোনও মন্তব্য করিনি। বিচার না করেই দল আমাকে শাস্তি দিল!”
তৃণমূল সূত্রে জানানো হয়েছে, দল থেকে সাসপেন্ড করার পাশাপাশি রাজ্যসভাতেও কুণালের আসন আলাদা করার জন্য আবেদন জানাতে চলেছে দল। দলীয় নেতাদের অনেকেই জানাচ্ছেন, সংসদে তাঁর আসন আলাদা হলেও কুণাল দলের হুইপ মানতে বাধ্য থাকবেন। কারণ, হুইপ না মানলে বা কোনও রকম দলবিরোধী কথা বললে দলত্যাগ বিরোধী আইন অনুযায়ী তাঁর সাংসদ পদ খারিজ হতে পারে।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, কুণালকে সাসপেন্ড করা হলেও অন্য যে দুই সাংসদকে একই সঙ্গে শো-কজ করা হয়েছিল, সেই শতাব্দী রায় ও তাপস পালের প্রতি নরম মনোভাবই নিচ্ছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কেন দু’ক্ষেত্রে দু’রকমের সিদ্ধান্ত, তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন পার্থবাবু।
তিন সাংসদকে নিয়ে গোলমালের সূত্রপাত গত ২০ সেপ্টেম্বর। সে দিন মধ্য কলকাতার ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে এক রক্তদান শিবিরের অনুষ্ঠানে দলবিরোধী মন্তব্য করার অভিযোগে কুণাল, তাপস ও শতাব্দীকে শো-কজ করে তৃণমূলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটি। যথাসময়ে তাঁদের কাছে শো-কজের চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হয় বলেও দলীয় নেতৃত্ব জানিয়ে দেন। তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, ২০ তারিখ তাপস-শতাব্দী দল নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কুণালের মতো এত কড়া ভাষায় আক্রমণ করেননি। |
পার্থবাবু জানান, ওই দিনের পর তাপস-শতাব্দী প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি। পাশাপশি রক্তদান শিবিরে তাঁরা যা বলেছিলেন, সে জন্য দুঃখপ্রকাশ করে সরাসরি দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিও লিখেছেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শো-কজ খতিয়ে দেখতে সর্বোচ্চ নেত্রীর কাছে রিভিউ পিটিশন করা যায়। পার্থবাবু বলেন, “তাপস-শতাব্দী দলনেত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তাঁরা অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এমন কোনও কাজের সঙ্গে ভবিষ্যতে কোনও দিনও তাঁরা যুক্ত থাকবেন না।” পার্থবাবু তো বটেই, দলের অন্য নেতাদেরও বক্তব্য, কুণাল দলনেত্রীকে চিঠি দেওয়া বা শো-কজের জবাব দেওয়ার পথে তো হাঁটেনইনি, উল্টে ২০ তারিখের পরেও মুখ বন্ধ না করে একটার পর একটা দলবিরোধী মন্তব্য করে গিয়েছেন। দলের নীতির বিরোধিতা করে গিয়েছেন। পার্থবাবু বলেন, “দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে, কালিমালিপ্ত করে ও মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে উন্নয়নের কাজ রাজ্যে চলছে, তাকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করে গিয়েছেন কুণাল।” তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, সে ক্ষেত্রে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কুণালকে সরাসরি সাসপেন্ড করা যেত। দলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় রেখেই তাঁকে প্রথমে শো-কজের চিঠি পাঠানো হয়। তার জবাব না পেয়েই কড়া ব্যবস্থা নিতে দল বাধ্য হয়েছে বলে জানান পার্থবাবু। তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য, তাপস-শতাব্দীকে আলাদা করে আসলে কুণালকে একঘরে করতে চেয়েছেন নেতৃত্ব। যেমন তাঁরা রাজ্যসভায় কুণালের আসন আলাদা করার জন্য আবেদন করতে চলেছেন।
তৃণমূলের সাধারণ পরিষদের বর্ধিত সভার ৪৮ ঘণ্টা আগে, কুণালকে সাসপেন্ড করে মমতা সংগঠনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের কাছে একটা কড়া বার্তা দিতে চেয়েছেন বলে দলীয় নেতাদের একাংশের অভিমত। কারণ, শুধু কুণালই নন, দলের অপর সাংসদ সোমেন মিত্র ও তাঁর স্ত্রী বিধায়ক শিখা মিত্রের কথাবার্তাতেও দলীয় নেতৃত্ব অসন্তুষ্ট। শিখাদেবীকে আগেই সাসপেন্ড করা হয়েছে বলে মুকুলবাবুদের দাবি। সোমেন-স্নেহধন্য কুণালকে এ দিন সাসপেন্ড করার মধ্যে দিয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব দলের বিক্ষুব্ধ নেতাদের সতর্ক করেছেন বলেই তৃণমূল অন্দরের অনেকের ধারণা। এমনকী, সোমেনবাবুর বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে পার্থবাবু বলেছেন, “আমরা সকলের উপর নজর রাখছি।’’
সোমবারের সেই সভায় যাওয়ার জন্য সোমেনবাবু আমন্ত্রণ পেলেও, কুণাল বা শিখাদেবী তা পাননি। তবে সোমেনবাবু শেষ পর্যন্ত সভায় যাবেন কি না, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানাননি। কিন্তু কুণালকে সাসপেন্ড করা নিয়ে ক্ষোভ চেপে না রেখেই সোমেনবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আসামীকেও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হয়। কুণালকে তা-ও করা হয়নি।” মুকুলবাবু অবশ্য বলেন, “কুণালের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তো এখনও আছে। দল থেকে তো এখনও ওঁকে বহিষ্কার করা হয়নি!” তৃণমূলের নেতৃত্বের একাংশের অভিমত, সোমবারের সভার আগে কুণালকে সাসপেন্ড করার অর্থ, তিনি যাতে ওই সভায় যেতে না পারেন। অন্য একটি অংশের বক্তব্য, কুণালের এমনিতেই যাওয়ার প্রশ্ন ছিল না। কারণ, তিনি আমন্ত্রিতই ছিলেন না। শুধু ওই সভা কেন, সাসপেন্ড হওয়ার ফলে তিনি এখন দলের কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিতেই অংশ নিতে পারবেন না। একঘরে করার প্রক্রিয়ায় এটাও একটি দিক।
তৃণমূল ভবনে রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী (কুণালকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবিতে যিনি তৃণমূলের অন্দরে সরব ছিলেন), বিধায়ক তাপস রায়কে পাশে বসিয়ে পার্থবাবু বলেন, “দলে কোনও ব্যক্তিই শৃঙ্খলার ঊর্ধে নন। দলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে মুকুল রায়, সুব্রত বক্সী এবং আমি সর্বসম্মত ভাবে কুণালকে সাসপেন্ড করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” তিনি জানান, দলীয় গঠনতন্ত্রের ধারা অনুসারে এ দিন থেকেই কুণালকে তদন্ত সাপেক্ষে সাসপেন্ড করা হল।
কুণালের দাবি, শো-কজের চিঠি তিনি পাননি। সাসপেনশন নিয়ে তিনি পার্থবাবু ও মুকুলবাবুর সঙ্গে কথা বলবেন। তাঁর কথায়, “আমি শো-কজের চিঠি পেলে দলের সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিতাম। ওটা পাইনি বলেই জবাব দিতে পারিনি। সমস্যা এখানেই। আমি দলকে একটা চিঠি লিখেছি।” পার্থবাবু ও মুকুলবাবু জানিয়েছেন, রক্তদান শিবিরের অনুষ্ঠানে দলবিরোধী মন্তব্য করার জন্য কুণালকে শো-কজ করা হয়েছিল। কিন্তু তা-ও প্রকাশ্যে দলবিরোধী বক্তব্যের জন্য তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তৃণমূলের অন্দরের খবর, দলীয় নেতৃত্ব কুণালের উপর এতটাই ক্ষুব্ধ যে, তাঁকে সাসপেন্ড ঘোষণার পরপরই দলীয় ওয়েবসাইট থেকে কুণাল সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পার্থবাবুর কাছে জানতে চাওয়া হয়, কবীর সুমনের বিরুদ্ধে দল কী ব্যবস্থা নিয়েছে? তাঁকে কি সাসপেন্ড করা হয়েছে? পার্থবাবু বলেন, “সুমন ভালই জানেন তাঁকে কী করা হয়েছে!” |