|
|
|
|
|
|
|
জাস্ট যাচ্ছি |
শুভময় মিত্র |
ও ব্লা ডি, ও ব্লা ডা’ গানটা বাজছে ঘরের এক কোণের জুক বক্স থেকে। চলছে সিডি-তে, তার পর স্পিকার থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বড় হলঘরটায়। সব টেবিল ভরতি, লোকজন আড্ডা মারছে, বিয়ার খাচ্ছে। বোতল নয়, পিচার থেকে, কারণ এটা হল ড্রাফ্ট বিয়ার। মুম্বইয়ের কোলাবা’য় রিগাল সিনেমার পাশে বিখ্যাত পাব, কাফে মনডিগর। এরাই প্রথম ড্রাফ্ট বিয়ার দেওয়া শুরু করে শহরে। স্রেফ এ জন্যে নয়, আসল মজাটা হল: বিখ্যাত কার্টুনিস্ট মারিও মিরান্ডা-র আঁকা ছবি দেওয়াল জুড়ে। মুম্বইয়ের ফুর্তিবাজ, হল্লাবাজ মানুষদের ছবি। কমিক স্ট্রিপের মতো আঁকা, স্মার্ট লাইন ড্রয়িং, রঙের হুল্লোড়। ন্যাদোস চেহারার পুরুষের সঙ্গে খলবলে নারী রয়েছেন, কামাতুর শরীরের ভাষা। এই ছবিটা, ম্যুরালই বলব, রয়েছে আমাদের টেবিলের সব থেকে কাছে। আমরা মানে, আমি আর আমার এক বন্ধু। সে পড়ায় আইআইটি-তে। সন্ধেবেলা একটু বসেছি আর কী। সে বলল, ‘কলকাতা নিয়ে হুতোম যেটা লিখেছিল, সেই নকশাটা কলকাতার কোনও পাবে নেই কিন্তু।’ কলকাতা নিয়ে কেউ কিছু বললে আমার আঁতে লাগে। একটু খেঁকিয়ে উঠলাম, ‘পাব নেই, কিন্তু পাপের অভাব আছে কি? অবশ্য সে দিক দিয়েও তোরা এগিয়ে, আমাদের তো আর দাউদ নেই, গলিগালায় কানা পঞ্চা, হাতকাটা ছোট্টু ব্যস।’ বলতে ঠিক চাইনি, তবুও মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘হেডলাইন হওয়ার মতো ব্লাস্ট হয়নি একটাও।’
|
|
ছবি: লেখক। |
চলছে গানটা, ওই কথাগুলো ঘুরেফিরে আসছে, মানেটা কী, তা জানি না। কে একটা লোক আর তার বউয়ের সুখী সংসার, বাচ্চাকাচ্চা, বেশ একটা হাসিখুশি ব্যাপার আছে, দেওয়ালের ছবিগুলোর মতো। আমার বন্ধু বলল, ‘বিট্ল্স’। এ দিক ও দিক ওয়েটারকে খুঁজতে লাগলাম, আরও নেব বলে। দরজার দিকে নজর পড়ল। দশাসই চেহারার বয়স্ক এক জন ঢুকছেন, চকরাবকরা হাফ শার্ট, বুকের বোতাম খোলা। কাঁচাপাকা অবিন্যস্ত চুল, অনেক দিনের না-কাটা দাড়ি, সানগ্লাসটা মাথায় তোলা। সঙ্গে গোড়ালির বয়সি ডজনখানেক মেয়ে। ‘কে রে? ফিল্মস্টার?’ ‘শোনো, মুম্বই মানেই সিনেমা নয়। অনেক ব্যাপার আছে, চুপচাপ দেখে যাও।’ মেয়েগুলোর জামাকাপড়ে কাপড় কম, বেশ লাগছে দেখতে, সব হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, কী বলছে শুনতে পাচ্ছি না, অকারণে হাসির ফোয়ারা উঠছে। যাঁকে ঘিরে এত আদিখ্যেতা, তিনি ওয়েটারকে আঙুলের ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে যা নেবে, সেটা দিতে। বেশ দিলদরিয়া হাবভাব। ‘এই মেয়েগুলো কারা?’ ‘যা ভাবছ তা নয়।’ আমার বন্ধু অনেক রকম মানে হয়, এমন একটা হাসি ভাসিয়ে দিল বিয়ার মাগের ওপর দিয়ে। ফুটফাট আওয়াজ করা, ধোঁয়া ওঠা সিজ্লার এসেছিল, তার একটু তুলে নিয়ে সে বলল, ‘সবে রাত ন’টা, এই তো বম্বে জাগছে, ধরে নাও ওরা হল প্রিয়ঙ্কা বা ক্যাটরিনা। তাতে তোমারই বা কী? আমারই বা কী? দেখে যাও। কেউ এখানে অন্যের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। জাস্ট দেখে যাও।’
আরব সাগরের জলটা যদি একেবারে চোখের কাছে এনে ফেলা যায়, তা হলে অনেক দূরে মুম্বইয়ের প্রতিফলন তাতে হবার কথা নয়। কারণ, বড় অশান্ত এ সমুদ্র। সদ্য ভরা বিয়ার জাগের কানায় চোখটা রাখলাম, চোখের কোলটা একটু ভিজে গেল ঘেমে ওঠা গ্লাসের ছোঁয়ায়। তামাটে সোনালি পানীয় ঘিরে ছিল অনেকখানি সুগন্ধি ফেনা। খুব মন দিয়ে দেখছিলাম ছোট ছোট বুদবুদ উঠে আসছে, যেন অদৃশ্য ডুবুরি নেমেছে নীচে। এ সব আসলে অন্য কিছু দেখার বাহানা, যাতে আশপাশের লোকজন বুঝতে না পারে আমি কোন দিকে তাকিয়ে আছি। আমার লক্ষ্যস্থল থেকে চোখ সরানো খুবই কঠিন কাজ। কারণ, একটা উত্তেজক ব্যাপার ঘটছে ওখানে।
ওদের বিয়ার এসে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই বিয়ার মাগ তুলে একসঙ্গে ঠেকিয়ে ‘চিয়ার্স’ বলতে গিয়ে উপচে পড়েছে অনেকটা। পড়েছে লোকটার জামায়। আসলে সব ক’টা মেয়ে চার পাশ থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, সামলাতে পারেনি আর। এখন ওরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভেজা শার্টের ওপর, কে আগে মুছিয়ে দেবে, ভাবখানা এই রকম। লোকটাকে আর দেখা যাচ্ছে না, সে নিশ্চয়ই মহা সুখে আছে, আমি দুম করে বলে বসলাম, ‘অসভ্য সব, এরা কেউ বিলো এইট্টিন নয় তো?’ ‘তুমি তো ওভালটিন খাওয়া মধ্যবিত্তের মতো করছ, যেটা খাচ্ছ সেটা খাও, আর দ্যাখো, দেখে যাও।’
জামা ভিজে গেছে বলে লোকটা মিথ্যে মিথ্যে রাগ দেখাচ্ছে। মেয়েগুলো আশকারা পেয়ে আরও বাড়াবাড়ি করছে। এক জন তো প্রায় টেবিলের ওপরে উঠেই পড়ছিল, অন্যরা জামা ধরে থাকায় সেটা হয়ে উঠল না। যেটা করতে গেল, সেটা আরও সাংঘাতিক। মেয়েটা গোলাপি টি-শার্ট খোলার মতলব করছে। অন্যরাও উসকোচ্ছে, ‘কাম অন, কাম অন’ চিত্কার শুরু হয়ে গেছে। জুক বক্সে ম্যাডোনার গান দিয়েছে এ বার। গলা চড়ছে। ড্রাম্স আর সিম্বাল-এর দাপটে কাঁপছে জায়গাটা। আমি বলেই ফেললাম, ‘বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু।’ বন্ধুও দেখলাম থম মেরে গেছে, নিশ্চয়ই গোলমালের আশঙ্কা করছে। ‘আমরা কি বিল মিটিয়ে বেরিয়ে যাব?’ ‘না, শেষটা দেখা দরকার’ বলে চোঁ করে মেরে দিল সবটা বিয়ার। আমি আড়চোখে দেখে নিলাম, সবাই গল্প আর খাওয়াদাওয়ার ভান করছে, কিন্তু নজর ওই টেবিলেরই দিকে। কে বলে মুম্বইয়ের লোক অন্যের ব্যাপারে মাথা দেয় না, এ রকম স্বঘোষিত হুংকার অনেক শোনা আছে। চোখ চলে গেল দরজায়।
একটা ছোটখাট জটলা, হইচই। রোগা চেহারার বয়স্ক এক মহিলা ঢুকলেন, দ্রুত পৌঁছে গেলেন সবার ফোকাস যেখানে, ঠিক সেইখানে। তার পর বাজ পড়ার মতো একটা আওয়াজ ইংরিজিতে, ‘আবার?’ বিধ্বস্ত লোকটা উঠে দাঁড়িয়েছে। বোকার মতো তাকিয়ে আছে মহিলার দিকে। চাপা স্বরে আমার বন্ধু বলল, ‘পারসি, বউ।’ মেয়েগুলো অস্বাভাবিক রকম চুপ মেরে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে জড়সড় হয়ে। মহিলা শক্ত গলায় বললেন, ‘গেট আপ অ্যান্ড গেট লস্ট।’ লোকটা আকাশে হাত ছুড়ে বলল, ‘বাট দিজ আর মাই স্টুডেন্টস। আমি প্রমিস করেছিলাম...’ কথা শেষ করার আগেই মহিলা ফটাস করে একটা চড় মারলেন স্বামীর গালে। মারতেই বিহ্বল মানুষটা ফ্যালফ্যাল করে চার পাশ দেখলেন, কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, মহিলা এক ধাক্কা মেরে বললেন, ‘ক্লাসরুম হিসেবে এটাকে খুব উপযুক্ত বলা যায় না।’ তার পর ওয়েটারকে ইশারা করে বললেন বিল পাঠিয়ে দিতে।
সবাই আবার নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মুখে কিচ্ছু বললাম না, কিন্তু আমরা দুজনেই জানি, ওদের পিছন পিছন যাব। রাস্তায় প্রচুর লোকজন, প্রথমে দেখতে পাচ্ছিলাম না, তার পর একটু এগোতেই পাওয়া গেল ওদের। মানুষটা ক্লান্ত পা টেনে টেনে হাঁটছেন, মহিলা শক্ত করে হাত ধরে আছেন। গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া থেকে ডান দিকে ঘুরলাম ওদের পিছন পিছন। তাজ হোটেল পেরোনোর পর ভিড় কম, অনেকটা শুনশান। সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, প্রচুর নৌকো ভাসছে, কোনও লোক নেই। এখন ওদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলাম স্পষ্ট ভাবে। শুনলাম, ‘ওরা আমার স্টুডেন্ট। আই বিলং টু দেম।’ দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়েছেন আবার। আমরাও। একটা বড় পাথরের ওপর উঠলেন মহিলা। তার পর নীচে তাকিয়ে বললেন, ‘বাট দে ডু নট বিলং টু ইউ।’ হাতটা এগিয়ে দিলেন। আলতো টানে তুলে নিলেন মানুষটাকে। ওঁদের পিছনে মেরিন ড্রাইভের আলোর মালা চলে গেছে মুম্বইয়ের রাতের আকাশের শেষ পর্যন্ত। সেখানে কোনও দিনই অন্ধকার হয় না। শেষ কয়েকটা শব্দ ভেসে এল, ‘ভুলে যেও না, ইউ ওনলি বিলং টু মি, কারণ তুমি কথা দিয়েছিলে আমাকে। আমিই তোমার প্রথম ছাত্রী।’ |
|
|
|
|
|