|
|
|
|
|
|
|
কলকাতার কাবুলি |
প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে আউড়ে যান খাইবার, কন্দাহার, কাবুল।
যদিও হাঁটা নিউ মার্কেটের সামনেটায়। ছেলে পড়ে ডানকুনির স্কুলে।
লিখছেন রূপসা রায় |
মা তুঝে সালাম’ বাজছে সুলতান খানের মোবাইলের কলারটিউনে। কলকাতায় বসবাসকারী পাশতুন কাবুলিওয়ালাদের নেতাই বলা চলে সুলতানকে। সংগঠনের নাম ‘খুদা-ই-খিদমতগার’। খান আবদুল গফ্ফর খানের সংগঠনের নামে রাখা হয়েছে নাম। কলকাতার ছ’হাজার কাবুলিওয়ালার অন্যতম সংগঠন।
ডানলপের সুপার মার্কেট। পাশেই সোনালি সিনেমা। চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছিলাম সুলতান ভাইয়ের জন্য। খানিক ক্ষণ পরে দেখা মিলল পাঠান পোশাকের লম্বা চওড়া মানুষটার। বছর সত্তর বয়স। পকেটে দুটো মোবাইল। গায়ে আতরের সুবাস। নিয়ে চললেন তাঁর বাড়িতে। ঢোকার আগে মিনিট দুয়েকের চেতাবনি, ‘আমার বাড়িতে চল্লিশ জন জড়ো হয়েছে। এমন কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না, যা বলতে ভয় পাবে। খারাপ লাগবে। আর একটা কথা, সুস্মিতাকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন নয়।’
তিন পুরুষ ধরে এই মানুষদের ঠিকানা কলকাতা। কিন্তু এঁরা সব্বাই মনে মনে যে দেশটার বাসিন্দা, তার নাম পাখতুনিস্তান। পাখতুনিস্তান নামে কোনও দেশ নেই অবশ্য। ১৯৪৭-এ, দেশ ভাগ যখন হয়েই গেল, খান আবদুল গফ্ফর খান পাকিস্তানের কাছে দাবি করেন স্বাধীন পাখতুনিস্তান। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ অবধি বার বার তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার। স্বাধীন পাখতুনিস্তানের প্রস্তাব কার্যকরী হয়নি কখনও। কিন্তু সেই স্বাধীন দেশের ভাবনা প্রোথিত রয়েছে পাখতুন বা খানেদের চেতনায়।
সেই দেশের কোথায় বাড়ি সুলতান খানের? কোন জেলা? কোন শহর? সুলতান খান বলেন, গারদেজ জেলা। ম্যাপ এঁকে বুঝিয়ে দেন, এই হল পাকিস্তান। আর এই আফগানিস্তান। একেবারে পাকিস্তান সীমানা লাগোয়া আমার বাড়ি। সুলতান খানের যদিও জেলা সম্পর্কে ধারণা রয়েছে, এই প্রজন্মের খানেদের সে ধারণাও নেই। শুধু মনের মধ্যে রয়েছে এক দেশের ছবি। প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে আউড়ে যান খাইবার, কন্দাহার, কাবুল। যদিও হাঁটা নিউ মার্কেটের সামনেটায়। ছেলে পড়ে ডানকুনির স্কুলে।
বছর পঞ্চাশেক আগে এ দেশে এসেছিলেন সুলতান। থাকতেন হায়দরাবাদের উর্দু গলিতে। করতেন রুটি তৈরির কাজ। একটু বড় হতেই চলে যান ‘ইস্ট বেঙ্গল-এর’ মথুরা চা বাগানে। ‘জেলা জলপাইগুড়ি।’ তার পর অসমের নওগাঁ জেলা। সেখানে বিয়ে করেন এক খানের মেয়েকে। তার পর বেশ কিছু দিন চা-বাগানের কাজ করে, সামান্য রেস্ত জমিয়ে, আসেন কলকাতায়।
|
|
রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ প্রকাশিত হয় ১৮৯২ সালে। ১২০ বছর কেটে গেছে, কাবুলিওয়ালারা বাঙালির কাছে বাইরের লোক বলেই থেকে গেলেন। ছবি বিশ্বাসের ছবিও বিশ্বাস জন্মানোর পক্ষে যথেষ্ট হয়নি। সুলতান বলেন, ‘আমরা কলকাতার। যো মুল্ক আপ কো ইজ্জত দেঙ্গে ও হি তো অপনা হোতা হ্যায়।’ কলকাতা ওঁদের ইজ্জত দিয়েছে। কিন্তু আপন করে নেয়নি। গল্পের রহমতের কথা উঠলে সুলতান বলেন, ‘তখন কাজু, পেস্তা, আখরোট আর টাটকা ফলের ঝুড়ি নিয়ে পায়ে হেঁটে, ট্রেনে চেপে আসতেন ওঁরা। সময় বদলেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশের সীমারেখা হয়েছে। এখন পাসপোর্ট লাগে, ভিসা লাগে। মাঝখানে পাকিস্তান প্রভুদের বদান্যতা লাগে।’ তাই সাধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে, ঘরের ভিতর ডিশ টিভিতে তিনি শোনেন আফগান খবর।
কিছু দিন আগেও দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের অদ্ভুত এক উপায় বের করেছিলেন সুলতানরা। ’৭০-’৮০-র দশকে, নিজেদের কথা রেকর্ড করতেন ক্যাসেটে। তার পর ও-দেশ যাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের মারফত পাঠাতেন আফগানিস্তানে। এখন অবশ্য মোবাইলের যুগ। সরাসরি কথা বলা যায়। কিন্তু যাওয়া সহজ নয়।
অবশ্য এই সত্তর বছর বয়সে পাসপোর্ট হয়েছে সুলতান ভাইয়ের। ইচ্ছা রয়েছে এ বছরই এক বার সে দেশ ঘুরে আসার। কিন্তু কোথায় যাবেন? কার কাছে যাবেন? সুলতান জানান, দেশে আত্মীয়স্বজন রয়েছেন, কিন্তু কাউকেই তেমন চেনেন না তিনি। তবু বলেন, ‘দেখে আসি এক বার ইয়ে ক্যায়সা মুল্ক হ্যায়, জিস লিয়ে ইতনে আফগান জান দিয়া।’
এক দিকে ‘নিজের মুল্ক’-এর অলীক বাস্তবতা, অন্য দিকে এত দিন থাকতে থাকতে যে জায়গা নিজের হয়ে গিয়েছে, সেই কলকাতার মায়া। এই দোটানায় চলছে দিন। ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, সবই রয়েছে। কিন্তু ভারতের নাগরিকত্ব পাননি প্রায় কেউই। তাতে অবশ্য আবেগের কমতি ঘটে না। সুলতান বলেন, ‘জ্যোতিবাবু যো হ্যায়, উসকো ম্যায় সেকেন্ড সুভাষচন্দ্র বোস বোলতা হুঁ।আমার কাছে সুভাষচন্দ্র আর জ্যোতিবাবুর একসঙ্গে একটা ছবি আছে।’ জ্যোতি বসু আর সুভাষচন্দ্র বসুর একসঙ্গে ছবি! ‘না, মানে আমি একসঙ্গে, পাশাপাশি রেখে দিয়েছি। জ্যোতিবাবু যখন হাসপাতালে ভরতি ছিলেন, দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে ঢুকতে দেয়নি।’
অনেক খান সাহেবের দেখা পাওয়া যাবে জুটমিল চত্বরে বা বড়বাজার এলাকায়। মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর অঞ্চলেও আছে ‘ডেরা’। কামারহাটি জুটমিল চত্বরের চার জন কাবুলিওয়ালা শ্রমিকদের কাছেও পরিচিত খান সাহেব নামে। বাজার মোড়ে মসজিদের পেছনে বাংলা মদের দোকান। তারই দোতলায় থাকেন সৈয়তুল্লাহ খান। প্রতি মাসের ৭ ও ২১ তারিখ দাঁড়ান মিলের সামনে। ওই দিনগুলিতেই হপ্তা পান শ্রমিকেরা। ধার নেন খান সাহেবের কাছ থেকে, ধার শোধ করেন। সমাজের হতদরিদ্র পরিবারগুলির ভরসা এঁরাই। মেয়ের বিয়ে বা সামান্য দোকান লাগানোএ জন্য এঁরাই চটজলদি টাকা ধার দেন। বিশ্বাস আর মুখের কথার উপরেই লেনদেন চলে। মূলধন বলতে দু’তিন প্রজন্ম আগেকার পূর্বপুরুষের সম্পত্তির উত্তরাধিকার। জুটমিলের শ্রমিকেরা এই কথা জানালেও নিজে অবশ্য এমন পেশার কথা স্বীকার করতে চাননি সৈয়তুল্লাহ। বলেন, ‘আমরা কাপড়ের ব্যবসা করি। সুদের ব্যবসা করি না।’ তবে তিনি অস্বীকার করলেও তো বাস্তবটা বদলায় না। সুলতান বলেন, ‘আমাদের ধর্মে টাকার লেনদেন করা হারাম। তাও করতে হয়। তবে অনেকেই অন্য ব্যবসা করে। কেউ আবার ওষুধ নিয়ে যায় এখান থেকে কাবুলে।’
সে দিন সুলতানের বসার ঘরে উপস্থিত ছিলেন অনেকে। কেউই প্রায় কথা বললেন না। নেতার মতই তাঁদের মত। সংগঠন থেকেই নির্ধারিত হয় এঁদের জীবনযাত্রা। আর্থিক সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা সব কিছুর সমাধানই হয় সংগঠনের তরফে।
নিজেদের মধ্যে পাশতু ভাষায় কথা বলেন। বাইরের লোকের কাছে হিন্দি বা উর্দু। দেশের থেকে অনেক দূরে থেকে ভাষা আর সংস্কৃতির সতর্ক সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে তৈরি করেন নিজেদের বৃত্ত। তাঁদের সামনে সত্তরের সুলতান খান আউড়ে চলেন আফগান দেশের ইতিহাস। দেশ-কালের সীমা ম্লান হতে থাকে। এক বার চলে যান ১৯১৯ সালের রাজা আমানুল্লাহ্ খানের দরবারে, ফিরে আসেন আমেরিকা-সোভিয়েতের ঠান্ডা যুদ্ধের ময়দানে। স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে ডক্টর নাজিবুল্লাহ্-র হত্যার ছবি। ১৯৯৬ সালে তালিবানরা দখল করে আফগানিস্তান। নাজিবুল্লাহ্কে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ল্যাম্পপোস্টে। কলকাতার সুলতান খানের মনে পড়ে যায়, বি.টি.রোডের ধারে আইএসআই বিল্ডিংয়ের সামনে নাজিবের সহকারী আতা মহম্মদ নাজিরের সঙ্গে দেখা করার মুহূর্তটা। সুলতান বলেছিলেন, এখানে কোনও অসুবিধা হলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তিনি আছেন।
নাজিবুল্লাহ্র হত্যার পরে দেশে যাওয়ার কথা ভাবতে গা ছমছম করে। মনে হয়, দেশটা যেন অন্য লোকের। আমেরিকার বা পাকিস্তানের। সারা দেশ জুড়ে পড়ে রয়েছে জাতীয় নেতাদের কাফন। আফগানিস্তানের জালালাবাদে একা শুয়ে রয়েছেন সীমান্ত গাঁধী। বলে ওঠেন সুলতান, ‘আমরা ইন্ডিয়ার নুন খেয়েছি। ইন্ডিয়ার যে কোনও দরকারে আমরা আছি। আচ্ছা, ইন্ডিয়ার সরকার আমাদের দেশটার জন্য কিছু করবে না? হামলোগ তো কমজোরি হ্যায়।’ তার পরেই অবশ্য অহং জেগে ওঠে। ‘জিন্না, নেহরু মিলে তো পাকিস্তান আর ভারত তৈরি করেছেন। আমাদের পাখতুনিস্তানের লড়াই তো শেষ হয়নি। খানরা লড়ছে।’ আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, দেশ ভাগের পর সীমান্ত গাঁধীর বেদনার্ত উচ্চারণ: ‘তোমরা আমাদের নেকড়ের মুখে ছুড়ে দিলে!’
সুলতান খানের বাড়িতে চারটি ঘর। সবকটায় কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া, প্রতিটি ঘরে অতিথিরা বসে আছেন মেঝেতে। রান্নাঘরে তৈরি হচ্ছে বিরিয়ানি। একেবারে কোণের ঘরে, যেটায় আমরা বসেছি, একটা পুরনো খাট, ড্রেসিং টেবিল, টিভি, অনেকটাই বাঙালি বাড়ির মতো। কী আশ্চর্য সেই আটপৌরে ঘরের দেওয়ালে তখন বীরগাথা, টুকরো স্মৃতি, সাধ, গল্প, মিথ দিয়ে তৈরি হচ্ছে এক ঝিলমিল ইতিহাস। তৈরি হচ্ছে তার উত্তরাধিকার। |
কৃতজ্ঞতা: নাজেস আফরোজ। ছবি: ‘কাবুলিওয়ালা’র স্থিরচিত্র, সুমন চৌধুরী। |
|
|
|
|
|