ফোটোগ্রাফ
দোকানের লোকটি দেখা গেল খুবই সহৃদয় আর সাহায্য করতে আগ্রহী। নিজে থেকেই, পিছনে টাঙানোর যত রকমের দৃশ্যপট স্টুডিয়োতে আছে, সবই দেখাল। ধুলোয় ধূসর হয়ে গেছে, জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া-ফাটা। একটিতে অজানা প্রাগৈতিহাসিক বৃক্ষশোভিত প্রাচীন পৃথিবীর ছবি। আর একটায় কতগুলো মাথাকাটা থাম। ফোটোগ্রাফার দেখছিল, কোনটার সামনে বসলে ওঁকে সবচেয়ে মানাবে। উনি, মানে মাদাম দুপোঁ বেশ হাসিখুশি মহিলা, যদিও তাঁর চুলের উগ্র চড়া রং, মুখের পুরু পাউডারের প্রলেপ, কানের গলার আর গায়ের সস্তা গয়না সব পড়শিদেরই বিরক্তি আর চক্ষুপীড়ার কারণ। উনি যদি একটু অন্য রকম সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, বা কোনও সুগন্ধি আদৌ ব্যবহার না করতেন, তা হলে এই ছোট মফস্সল শহরে হয়তো আর একটু সম্মান পেতেন।
মাদাম ধুলোটে দৃশ্যপটগুলোর দিকে খুব সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। জীবনে ফোটো তুলেছেন মাত্র দু’বার। এক বার মার্সাই থেকে জাহাজে ওঠার আগে, পাসপোর্টের জন্য। আর এক বার আমেরিকায় এক নাবিকের সঙ্গে এক বিনোদনকুঞ্জে। স্বাভাবিক ভাবেই সেই ছবিটা আর মা’কে পাঠাননি। এক নাবিকের সঙ্গে তাঁকে দেখলে মা কী ভাবতেন, বিশেষ করে মা যখন সমুদ্র আর সমুদ্রের সঙ্গে যোগ আছে এমন সব কিছুই ভীষণ অপছন্দ করেন? মহিলা ফের ফোটোগ্রাফারকে বুঝিয়ে বললেন, তিনি ঠিক কী চান। ‘আমি আমার মা’কে একটা ছবি পাঠাতে চাই। ছবিটা দেখে যেন ওঁর মনে হয়, আমি একটা সত্যিকার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বা বসে আছি। আমার নিজের বাড়ি।’
লোকটার অবশ্য মাদামের এই মনোবাসনার কথা অনেক আগেই মুখস্থ হয়ে গেছে। সে এ-ও জানে, ওই ছবির তলায় তিনি কী লিখে দেবেন। ‘আমার আদরের মা’কে আমি, আমার বাড়ির উঠোনে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সঙ্গে।’ পিছনে একটা সুন্দর বাড়ির দৃশ্য সহজেই সাজানো যাবে। যেটা নেই, সেটা হল এক জন সঙ্গী ওই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। ‘এটা কিন্তু আপনার ব্যাপার। কাল আপনার বান্ধবীকে নিয়ে চলে আসুন। কথা দিচ্ছি দুজনের একটা নিখুঁত ছবি আমি তুলে দেব।’ মাদাম দুপোঁ এর পরও তিন-চার বার দোকানে ফিরে এসেছেন। ফোটোগ্রাফার একই রকম সহৃদয় ব্যবহার করেছে, উত্‌সাহ দিয়েছে। ‘এই তো কালকেই এই ক্যানভাসটার সামনে বসিয়ে দুজন ভদ্রমহিলার ছবি তুললাম। অসাধারণ। তাকিয়ে দেখুন। মনে হচ্ছে যেন একটা সুদৃশ্য অট্টালিকার সামনের এক মনোরম বাগান।’ মাদাম দুপোঁ ছবিটার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। সত্যিই সুন্দর। দুজন তাদের ছোট্ট বাগানে বসে চা খাচ্ছে। তাঁর নোংরা হতশ্রী বাড়িতে যখন ফিরে এলেন, মনটা অনেকটা হালকা, ফুরফুরে।
তাঁর নিরানন্দ অন্ধকার আবাসের মাত্র একশো মিটার দূরে থাকেন এক স্কুলশিক্ষিকা। তিনিই পাড়ার একমাত্র মানুষ, যিনি দুপোঁর মৃদু অনিশ্চিত অভিবাদনের কখনও কখনও জবাব দেন।
‘শুভসন্ধ্যা’
‘হ্যাঁ, শুভস’
বেচারা চুল রং-করা দুপোঁর পা দুটো সংকোচে কাঁপতে শুরু করে। শব্দগুলো তাঁর ঠোঁটের ডগা থেকে বাতাসে মিলিয়ে যায় আর তিনি গিয়ে ধাক্কা খান রাস্তার ধারের দেওয়ালে। ওপরে তাকাবার সাহস জোগাড় করতে পারেন না। মার্বেলের বারান্দা থেকে ঝুঁকে দাঁড়ানো সেই দিদিমণিকে খুবই শুকনো দেখায়। মনে হয়, ভীষণ বিষণ্ণ আর পরাজিত। বারান্দাটাও অনেকটা ওই স্টুডিয়োর ধুলোটে দৃশ্যপটের মতো।
অবশেষে এক দিন বিকেলে মাদাম দুপোঁ দিদিমণির বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। যখন চার পাশে কয়েকটা রাস্তার কুকুর ছাড়া অন্য কেউ নেই। খড়বোঝাই একটা গাড়ি ঠিক সেই সময় পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। ওই গাড়ি পাশ দিয়ে গেলে, কিছু চাইলে সে ইচ্ছে পূরণ হয়। তিনি আবেগের বশে হঠাত্‌ই দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর পক্ষে যতটা ভাল করে বোঝানো সম্ভব, চেষ্টা করলেন। একটা ফোটো তোলায় একটু সাহায্যের দরকার। ওঁর সঙ্গে যদি থাকেন এক জন বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারার কেউ মানে এই মহাশয়ার মতো বলে একটু হাসলেন, ভাবলেন এই তোষামোদ হয়তো কাজে লাগবে। হ্যাঁ, তিনি স্কুলের সময়ের পরেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করবেন। তা হলে আগামিকাল, স্কুলের ছেলেমেয়েরা সব বাড়ি চলে যাওয়ার পর দেখা হবে।
‘অনেক, অনেক ধন্যবাদ...’
মাদাম দুপোঁ কিছুতেই ঠিকঠাক মনে করতে পারলেন না যে তিনি শুধু নিজেই কথা বলে গিয়েছিলেন, না ওই মহিলাও কিছু বলেছিলেন। মহিলা তাঁর প্রস্তাবে ‘হ্যাঁ’ বলেছিলেন, না ‘না’ বলেছিলেন? কিন্তু একটা কথা তাঁর মনে পড়ছিল যে কথাটা তিনি বহু দিন কারও মুখে শোনেননি। কথাটা হল, ‘সানন্দে’।
শেষ পর্যন্ত, ভূমণ্ডলের অন্য পিঠের এই অচেনা দেশে কেউ এক জন তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফোটোর দোকানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তিনি ভাবছিলেন, হয়তো এইখান থেকেই তাঁর জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। ওই দিদিমণি কেমন সহজে উত্তর দিলেন, যেন ওই ধরনের প্রস্তাবে অনায়াসেই রাজি হওয়া যায়। ঘটনার ছোটখাটো খুঁটিনাটিগুলো তাঁর মনের শান্তিটা আবার ফিরিয়ে দিল।
ওঁরা চেয়ারগুলো সাজাচ্ছিলেন, টেবিলটা সরিয়ে বসাচ্ছিলেন, পালকের ঝাড়ন দিয়ে ধুলোভরা কার্ডবোর্ডের তৈরি বারান্দাটা ঝাড়ছিলেন। ফোটোগ্রাফার জিনিসপত্র টানাটানি করে ক্লান্ত হয়ে বার বার খোলা দরজা দিয়ে রাস্তা দেখতে যাচ্ছিল। স্কুলের ছেলেমেয়েদের হুড়মুড় করে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে দেখে ঘরে ঢুকে জানাল, দিদিমণি বোধহয় এত ক্ষণে দোকানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছেন। ‘উনি যে কোনও সময় এসে পড়বেন’, মাদাম বললেন, ‘বোধহয় বেরুবার আগে একটু সাজগোজ করে নিচ্ছেন।’
আরও পনেরো মিনিট কেটে গেল। স্কুলের বাচ্চারা রাস্তায় হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছে। তাদের সারা গায়ে, জামাকাপড়ে নোংরা। হুল্লোড়ে সবার কান ঝালাপালা। তারা কলা খাচ্ছে আর খোসাগুলো হিংস্র আনন্দ ছুড়ে ছুড়ে রাস্তায় ফেলছে, অপেক্ষা করছে কখন কেউ পিছলে পড়বে। তাদের অন্য রকম কিছু করার ইচ্ছে কেন কখনও হয় না, তা তারা নিজেরাই জানে না।
‘ওঁর কিন্তু ইতিমধ্যে চলে আসা উচিত ছিল’, ফোটোগ্রাফার বলল। ‘খুব দুঃখের সঙ্গে বলছি, কিছু ক্ষণের মধ্যেই ছবি তোলার জন্য যথেষ্ট আলো থাকবে না।’
তবুও মাদাম অপেক্ষা করতে লাগলেন। দোকানের শান্ত ক্ষুদ্র কোণটিতে হাসিমুখে বসে আশায় আর আনন্দে ভরপুর। বহু দিন এ রকম আরামদায়ক সুন্দর জায়গায় এত ক্ষণ বসে থাকার সুযোগ পাননি। তাঁর হৃদয় এক সহজ গৌরব আর আনন্দে ভরে ছিল।
দিনান্তের ছায়া যখন মাটি ছুঁল, মাদাম দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। বিষণ্ণতা লুকিয়ে রেখে হাঁটতে শুরু করলেন। দোকানে বলে গেলেন, কাল তিনি আবার আসবেন। দিদিমণি আজ নিশ্চয়ই আসার কথাটা একদম ভুলে গেছেন।
বাঁকটা ঘুরে বাড়ির গলিটায় ঢুকতেই এক ঝলকে দেখতে পেলেন, দিদিমণি তাঁর বারান্দা থেকে খুব দ্রুত সরে যাচ্ছেন। দড়াম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দটা তাঁর গালে একটা সপাট চড়ের মতো এসে লাগল। গরম হয়ে ওঠা গালে জ্বালাটা টের পাচ্ছিলেন।
এ রকম একটা ঘটনা মন থেকে মুছে ফেলা খুবই কঠিন। বিশেষ করে যদি কারও জীবন হয় লাগাতার একঘেয়েমিতে ভরা। মাদাম আগে সপ্তাহে এক দিন বা দু’দিন বাইরে বেরুতেন। আজকাল অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। কখনও মাস পেরিয়ে যায় কিন্তু তিনি তাঁর সেই ভয়ানক দেওয়াল-ঘেরা বাড়ির বাইরে পা রাখেন না। আর কখনও সেই বিষণ্ণ বিশুষ্ক দিদিমণিকে তাঁর মার্বেলে বাঁধানো বারান্দায় সুখ বা ভালবাসার অপেক্ষায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেননি।
ফোটোগ্রাফার ক্যানভাসে আঁকা সব পশ্চাত্‌পটগুলো, যেখানে কাল্পনিক গাছপালায় সব আশ্চর্য পত্রপুঞ্জ আঁকা আছে, গুদামঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মেকি রেলিং-এর গায়ে জমেছে এক পাতলা ধুলোর আস্তরণ, যা এই শহরের হৃদয়চূর্ণ, তার শান্ত স্তব্ধ প্রহরের স্বাক্ষর।
স্কুলপড়ুয়ারা এখনও কলা খেয়ে তার খোসাগুলো রাস্তায় ফুটপাতে ছুড়ে ফেলে, তাদের বিশুদ্ধ বিকারের আনন্দে। বিশেষ করে যখন উত্তুরে বাতাস বইতে শুরু করে, তখন তাদের হিংস্র আনন্দেও যেন জোয়ার আসে। চারিদিকে তখন শোনা যায় বিরক্ত মা’দের চিত্‌কার আর ক্ষিপ্ত বাবাদের হুংকার।
মাঝে মাঝে কথাটা বাড়িয়ে বলা স্তোকবাক্য নয় আমাদের সবাইকেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে সব কিছু ঝেড়ে ফেলে জীবনযাপন চালিয়ে যেতেই হয়।

(সংক্ষেপিত)
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী।
অনুবাদ: সৌম্যশঙ্কর মিত্র।





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.