পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারে রাজ্য সরকার। সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারে নাগরিক সমাজ। কেন্দ্র বলতেই পারে, পশ্চিমবঙ্গে এখনও বাজির শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেল। কিন্তু বাজি প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীরা জাতীয় পরিবেশ আদালতের দেওয়া ২২ অগস্টের রায়কেই শিরোধার্য করে দেদার শব্দবাজি তৈরি ও বিক্রি করে চলেছেন। শব্দবাজির আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত দক্ষিণ ২৪ পগরগনার মহেশতলা, বজবজ, চম্পাহাটি, হারালে ২২ অগস্টের পর থেকে একই সঙ্গে খুশির হাওয়া ও ব্যস্ততা।
একটি গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, বারুদ মাখা রুপোলি হাতে একের পর এক চকোলেট বোমার সলতেতে আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে পাশের বাঁশবাগানে। তার পর কান ফাটানো আওয়াজ। চকোলেট বোমা যাঁরা ফাটাচ্ছেন, তাঁরা কেউ কান চেপে ধরে রাখছেন না। বরং, কান পেতে শুনছেন বাজি ফাটার বিকট আওয়াজ। কারণ, ওঁদের কেউ কারিগর, কেউ আবার প্রস্তুতকারক কোনও সংস্থার মালিক। শব্দ শোনার পর মশলার হেরফের ঘটিয়ে আরও শব্দ বাড়ানো যায় কি না, তা নিয়ে শলাপরামর্শ চলছে। কত কম মশলা দিয়ে তৈরি বাজি কত জোরে শব্দ করে ফাটতে পারে, তা নিয়েই বাঁশবাগানে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
|
চলছে অবাধে চকোলেট বোমা তৈরি। শনিবার দক্ষিণ শহরতলিতে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী। |
কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ও এই রাজ্যে শব্দবাজি নিষিদ্ধ করতে রায় দিয়েছিলেন যিনি, সেই ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি বলেছেন, এ বছর উৎসবের মরসুমে বাজি নয়, বোমা ফাটবে।
১৯৯৭-র অক্টোবর থেকে ২০১৩-র ২২ অগস্টএই ১৬ বছরেও শব্দবাজি ওই সব এলাকায় তৈরি হত, তবে যথেষ্ট গোপনীয়তা বজায় রেখে।
কিন্তু জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায়ের পরেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাজির আঁতুড়ঘরে হই হই করে শব্দবাজি তৈরি করতে নেমে পড়েছেন প্রস্তুতকারকেরা। আর ব্যবসায়ীরা সে সব পাঠিয়ে দিচ্ছেন রাজ্যের ও রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন বাজারে।
ঢালাও ‘অর্ডার’ পেয়ে মহেশতলা, বজবজ, চম্পাহাটির ঘরে ঘরে এখন শব্দবাজি তৈরির ধুম। শুধু পরিবারের পুরুষ সদস্যরা নয়, হাত লাগাচ্ছেন গৃহবধূ-সহ বাড়ির মহিলারা, এমনকী ছোটরাও। এমনই একটি বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সকাল সকাল উঠে রান্না সেরে ঘরের মধ্যেই শব্দবাজি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। কেউ বাজির বিভিন্ন মশলা নির্দিষ্ট ‘ভাগে’ মেশাচ্ছেন, কেউ সলতে তৈরি করছেন। গৃহবধূরা মূলত ঝটপট রাংতা কাগজে পাটের সুতলি দিয়ে বাঁধা বাজি মুড়ে দিচ্ছেন।
গ্রামের মধ্যে রাস্তার দু’ধারে চট পেতে শুকোছে সুতলি বাঁধা চকোলেট বোমা। পাইকারি বাজারে ১০০টি চকোলেট বোমার একেকটি প্যাকেটের দাম পড়ছে ৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। একই রকম বাজিতে কেন এই দামের পার্থক্য? এক ব্যবসায়ী বলেন, “প্রথমত, আওয়াজ কমবেশির উপর দাম নির্ভর করছে। দ্বিতীয়ত, কোনও প্যাকেটে রাংতা কাগজে মোড়া সুসজ্জিত বাজি নয়, শুধু সুতলি বাঁধা চকোলেট বোমা থাকছে। সেগুলোর দামও কম।”
কিন্তু এর মধ্যেই গত ২৩ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ ২৪ পরগনার হারালে জেলা পুলিশ অভিযান চালিয়ে মোট ৩০ হাজার চকোলেট বোমা বাজেয়াপ্ত করেছে। আসলে জাতীয় পরিবেশ আদালত রায় দেওয়ার প্রায় এক মাস পর ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য পরিবেশ দফতর।
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “পর্ষদ এখনও নতুন নির্দেশিকা জারি না করায় আমরা ধরে নিচ্ছি, ৯০ ডেসিবেলের বেশি শব্দসীমার বাজি অর্থাৎ মোটের উপর শব্দবাজি এই রাজ্যে তৈরি, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। আমরা সেই অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেব।” তবে কর্তাদের মনোভাব এ রকম হলেও থানার পুলিশ অফিসার ও কর্মীরা জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক ধরপাকড় ও শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করার ব্যাপারে দ্বিধায় রয়েছেন।
আবার প্রশাসনিক স্তরে এই সংশয়ের জন্যই বিপুল পরিমাণ শব্দবাজি এখনই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। লালবাজারের এক শীর্ষ অফিসারের কথায়, “যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। ভোগান্তি হবে আমাদেরই। সুপ্রিম কোর্টে যদি রাজ্যের জয় হয়, তা হলেও ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়া এত শব্দবাজি কী ভাবে ধরা সম্ভব? আর ক’জনকেই বা আমরা সেগুলোর ব্যবহার করা থেকে বিরত করতে পারব?”
রাজ্য পুলিশ ৯০ ডেসিবেল শব্দসীমা ধরে চলবে বলে জানালেও কলকাতা পুলিশ এখনও এই ব্যাপারে নির্দেশিকা জারি করেনি। কেন? কলকাতা পুলিশের ওই শীর্ষ অফিসার বলেন, “বিষয়টি এখনও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। অবস্থান স্পষ্ট করার দায়িত্ব পর্ষদের।”
আর এই চাপানউতোরের মধ্যেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাজি-তল্লাটে ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য শব্দবাজি। |