জাতীয় পরিবেশ আদালত যা-ই নির্দেশ দিক, শব্দবাজি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ২০০৫ সালের রায়ই শেষ কথা বলে জানাল কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রক। আট বছর আগে শীর্ষ আদালতের ওই রায়ে পশ্চিমবঙ্গে শব্দবাজি নিষিদ্ধ করার বিষয়টিতে সিলমোহর পড়েছিল। শনিবার কেন্দ্রের ওই চিঠি এসে পৌঁছেছে সবুজের অভিযান নামে এ রাজ্যের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে।
২০০৫-এর ১৮ জুলাইয়ের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী, সাধারণ মানুষকে শব্দবাজির বিকট আওয়াজ শুনতে বাধ্য করা যায় না। সুপ্রিম কোর্ট জানায়, শব্দবাজি ফাটানো ও তার বিকট শব্দ এক-দু’জনের কাছে তৃপ্তির বিষয় হতে পারে, কিন্তু যাদের কষ্ট হয়, তাঁদেরও সেই আওয়াজ শুনতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ সংবিধানের ২১ নম্বর ধারায় নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করার, রাতে ঘুমোনোর ও বিশ্রাম নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
শীর্ষ আদালতের ওই নির্দেশের কথা কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রক ফের স্মরণ করিয়ে দেওয়ায় রাজ্যে বাজির শব্দসীমা আগের মতো ৯০ ডেসিবেলই থাকল বলে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আইন সহায়তা কেন্দ্র মনে করছে। প্রসঙ্গত, ৯০ ডেসিবেল শব্দসীমার মধ্যে কোনও শব্দবাজি তৈরি কার্যত সম্ভব নয়। সে দিক দিয়ে ১৯৯৭ থেকে এ পর্যন্ত রাজ্যে শব্দবাজি তৈরি, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল।
কিন্তু জাতীয় পরিবেশ আদালত গত ২২ অগস্ট তার রায়ে এ রাজ্যেও বাজির শব্দসীমা দেশের অন্যান্য অংশের মতো ১২৫ ডেসিবেল করতে বলে শব্দবাজিকে ছাড়পত্র দেয়। ওই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে শব্দবাজির বিরুদ্ধে পথে নামে সবুজ মঞ্চ-সহ বিভিন্ন সংগঠন। তাদের তরফেই সবুজের অভিযান-এর আইন সহায়তা কেন্দ্র চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রককে। ওই চিঠিতে সুপ্রিম কোর্টের ২০০৫-এর জুলাই মাসের ওই নির্দেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এ রাজ্যে বাজির শব্দসীমা কী হবে, তা জানতে চাওয়া হয়। তারই উত্তরে গত ২৩ সেপ্টেম্বর কেন্দ্র ওই চিঠি পাঠিয়েছে।
ওই আইন সহায়তা কেন্দ্রের সচিব এবং রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের কাছে গত ৯ সেপ্টেম্বর ওই চিঠি পাঠিয়ে তাদের অবস্থান জানতে চান। মন্ত্রকের অতিরিক্ত অধিকর্তা আর এন জিন্দল বিশ্বজিৎবাবুকে লিখিত ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, বাজির শব্দসীমার ক্ষেত্রে ২০০৫-এর জুলাই মাসে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের ওই নির্দেশ অনুযায়ীই চলতে হবে।
এ দিন বিশ্বজিৎবাবু বলেন, “আমরা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পরিবেশ দফতরকেও চিঠি দিয়েছিলাম। তাঁরা উত্তর দেওয়ার সৌজন্য দেখাননি। কেন্দ্র কিন্তু এই ব্যাপারে অবস্থান স্পষ্ট করে আমাদের চিঠির উত্তর দিল। কেন্দ্রের এই চিঠির প্রতিলিপি আগামী সপ্তাহেই পর্ষদ, রাজ্য পরিবেশ দফতর, স্বরাষ্ট্র সচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং কলকাতা পুলিশের কমিশনারকে আমরা পাঠিয়ে দেব।” একই সঙ্গে বিশ্বজিৎবাবু জানান, জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ আগামী সপ্তাহেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছে।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংগঠন সবুজ মঞ্চ-এর পক্ষে নব দত্ত বলেন, “আমরা গোড়া থেকেই বলে আসছি, জাতীয় পরিবেশ আদালত বা ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের সামনে যথাযথ ভাবে বিষয়টি রাজ্যের পক্ষ থেকে উপস্থাপনায় ত্রুটি ছিল। তা না হলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ কোনও ট্রাইব্যুনাল কী ভাবে খারিজ করতে পারে? তা ছাড়া, জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায়ে রাজ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।”
রাজ্য পরিবেশ দফতরের এক কর্তা বলেন, “কেন্দ্রের ওই চিঠি পেলে আমাদেরই সুবিধাই হবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থানই দৃঢ় হবে।” এ কথা বললেও এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশের পরেও রাজ্য এখনও বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায়নি। বরং, জাতীয় পরিবেশ আদালতের কাছেই তাঁরা ফের পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছেন বলে পরিবেশ দফতরের এক কর্তা জানান। নাগরিক সমাজের অভিযোগ, এই ভাবে অনর্থক সময় নষ্ট করে সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে শব্দবাজি ক্রমশ বেশি মাত্রায় রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশ্বজিৎবাবুর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা যেখানে সদর্থক, সেখানে পরিবেশ দফতর ও পর্ষদ কর্তাদের একাংশ কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছেন না, এটা দুর্ভাগ্যজনক।”
অন্য দিকে, সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায় বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার কী চিঠি পাঠিয়েছে, তা আমরা জানি না। জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায় আমাদের পক্ষেই গিয়েছে। যা-ই হোক, আমরা আইনি লড়াইয়ের জন্য তৈরি।” |