আমি রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ নই। রবীন্দ্রনাথকে প্রথম চিনেছিলাম স্কুলে। ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটি তখন পাঠ্য ছিল। কিন্তু বছর পাঁচেক আগেও তাঁকে নিয়ে আলাদা করে ভাবার আগ্রহ জন্মায়নি। ছবিতে তাঁর সাদা দাড়ি আর আলখাল্লা দেখে বরং ওশো রজনীশের কথা মনে পড়ত। শুধু ওশোর দুষ্টু হাসিটি নেই, এই যা!
একটা ব্যাপার কিন্তু ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট হিসাবে খেয়াল করেছিলাম। বাঙালি বন্ধুরা আড্ডায় জড়ো হলে প্রায়ই রবীন্দ্রসংগীত গায়। আমার কান ওই গানে অভ্যস্ত নয়, ফলে সুরগুলি প্রায় এক ঠেকত। কিন্তু এটা বুঝতাম, বন্ধুরা নিছক গান গাইছে না। পুরনো স্মৃতিও ঝালিয়ে নিচ্ছে। ওই গানেই যেন কালেক্টিভ আইডেন্টিটি। কোনও কবির লেখা গান একটা জাতি... অন্তত তার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অংশের আইডেন্টিটি হয়ে গিয়েছে, আগে দেখিনি।
শেষ ঘটনাটা কয়েক বছর আগের। রবীন্দ্রনাথের দেড়শো বছরে তাঁর আঁকা ছবি নিয়ে ন্যাশনাল আর্ট মিউজিয়ামে প্রদর্শনী। উদ্যোক্তারা অনুরোধ করলেন, একটি বক্তৃতা দিতে। ছবিগুলি দেখে চমকে গেলাম!
|
আমি আর্ট ক্রিটিক নই। কিন্তু ছবিগুলি যেন মনোবিশ্লেষণের চুম্বক! রেখা বা রং চাপানো কোথাও কোথাও দুর্বল। ডিম্বাকার মুখ, নারী না পুরুষ স্পষ্ট বোঝা যায় না। কিন্তু নারীর মধ্যে পৌরুষ বা পুরুষের মধ্যে নারীত্ব... এই জিনিসটাও সত্তর বছর বয়সে রং-তুলিতে ধরছেন তিনি! গ্রেট মাইন্ড মাস্ট বি অ্যান্ড্রোজিনাস। মহৎ স্রষ্টারা একই সঙ্গে নারী ও পুরুষ। |
ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখলাম, নন্দলাল বসুকে উনি বলেছেন, পোর্ট্রেটগুলির চোখ ওঁর বউঠান কাদম্বরী দেবীর মতো। শুধুই কাদম্বরী? স্মৃতির প্রলেপে কি লুকিয়ে নেই মা সারদা দেবী? কিংবা তিনি নিজে? এই ‘সাবজেক্টিভিটি’... পিকাসো, মুংখ্ ছাড়া কোথায়?
জানার ইচ্ছে পেয়ে বসল। অনুবাদ আনিয়ে পড়লাম ইউরোপ-প্রবাসীর পত্র, জীবনস্মৃতি, ছেলেবেলা। তার পর গল্পগুচ্ছ আর উপন্যাস। কবিতা শেষে।
|
মাতৃহীন শিশুদের জন্য কবিতা লিখছেন বাবা রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু নিজের মাতৃহারা অবচেতনও ফুটে বেরোচ্ছে। মায়ের মৃত্যু নিয়ে ‘জীবনস্মৃতি’র লাইন উল্লেখ্য: ‘বাড়িতে যিনি কনিষ্ঠা বধূ ছিলেন, তিনিই মাতৃহীন বালকদের ভার লইলেন।’ সারদা দেবীর মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ১৪। ছোট ভাই-বোনও নেই। তা হলে মাতৃহীন বালকরা কারা? এখানেই মনের কথা বুঝতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ছোট ছেলে, মা তাঁর নানা আবদারকে প্রশ্রয় দেন। বাড়ির নিয়মে সুতো ছিঁড়ে গেল, আসতে হল ভৃত্যরাজকতন্ত্রে। কিন্তু বালকের মন মানেনি। স্মৃতিতে এই ঘটনা ছিল বলেই ‘ছুটি’র মতো গল্প।
একটা বাচ্চা কী ভাবে বেড়ে ওঠে? মায়ের সঙ্গেই প্রাথমিক সম্পর্ক। অতঃপর বোঝে, মায়ের মনোযোগ শুধু তার জন্য নয়। সংসারে আরও এক জন আছেন। বাবা। ‘আজকে বুঝি পাসনি বাবার চিঠি’ বা ‘আমি এখন বাবার মতো বড়’ গোছের লাইন তাই ‘শিশু’-র কবিতায়।
কল্পনাপ্রবণ ছেলেটির স্কুল অসহ্য লাগে। অন্য বালকরা স্কুলে গিয়ে সমবয়সিদের সঙ্গে মেলামেশা করে। দলগত খেলা এবং ভায়োলেন্ট দুষ্টুমি এই বয়সের বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথও ভায়োলেন্ট ছিলেন, নইলে বাড়ির রেলিংগুলিকে ছাত্র ভেবে বেত মারতেন না। কিন্তু দল বা ‘পিয়ার গ্রুপ’-এর সঙ্গে মিশতে পারেননি। সকালে কানা পালোয়ানের সঙ্গে কুস্তি লড়েও ‘এফিমিনেট’ ছিলেন। ওঁর সঙ্গে স্কুলের এক বন্ধু প্রায়ই যাতায়াত করত। এক গাড়িতে দিনের পর দিন গিয়েও ছেলেটি তাঁকে ভুল করে মেয়ে ঠাউরেছিল!
|
সাধারণ বালকরা সমবয়সিদের থেকে এমন ব্যবহার পেলে বিষণ্ণতায় ভোগে। রবীন্দ্রনাথ রেহাই পেলেন তাঁর প্রতিভায়। ‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি’ লেখেন, শিক্ষকরা প্রশংসা করেন।
এই সময়েই দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ডালহৌসি। বাবা তাঁকে ভরসা করেন, ক্যাশবাক্সের চাবি রাখতে দেন। পেলেন আর একটি পিতৃসম্পদ: আধ্যাত্মিকতা। দুজনে সকালে উপাসনায় বসেন। কয়েক মাস পর যখন ফিরলেন, অনেক আত্মবিশ্বাসী। তৈরি হয়েছে পুরুষালি আইডেন্টিটি।
রবীন্দ্রনাথের অন্তর্জগতে ঠাকুরদা ও বাবা সমান উপস্থিত। দ্বারকানাথের মতোই ‘গুড লাইফ’ পছন্দ করতেন, ইউরোপে গিয়ে প্রচুর নাচগান ও পানভোজন করেছেন। বয়ঃসন্ধির অন্যতম লক্ষণ: বাবার সঙ্গে ছেলের ইগো-সংঘর্ষ। রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ প্রবাসীর পত্রে লেখেন, ‘ছেলেবেলা থেকে আমাদের কানে মন্ত্র দেওয়া হয়, পিতা দেবতুল্য।’ জীবনস্মৃতির একটা জায়গা খুব ভাবায়। বালক রবীন্দ্রনাথ মা’কে দাহ করে ফিরে দেখছেন, বাবা বারান্দায় স্তব্ধ হয়ে উপাসনায়। মহর্ষি সে দিন শ্মশানে যাননি? এই স্তব্ধতা অপরাধবোধের? না আধ্যাত্মিকতার?
|
সমবয়সি বালকবালিকারা যেমন পরস্পরকে টিজ করে, সম্পর্কটা সে রকম। কখনও বউঠানের জুতো লুকিয়ে রাখছেন। কাদম্বরী পাল্টা বলছেন, তোমাকে গুরুমশাইগিরি করতে হবে না। ভৃত্যরাজকতন্ত্রে রবীন্দ্রনাথ আধপেটা খেয়ে থাকতেন। কাদম্বরীই তাঁকে প্রথম মুখের স্বাদ জুগিয়েছিলেন। বউঠাকরুনের চিংড়ি চচ্চড়ির কথা লিখেও গিয়েছেন। দুই কিশোরকিশোরীর মধ্যে চোরা সেক্সুয়াল টেনশন ঢুকে পড়ে। ১৭ বছর বয়সের রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে প্রায়ই নাচগানে যেতেন। চিঠিতে কাদম্বরীকে স্কোয়ার ড্যান্সের বর্ণনা দিচ্ছেন। তারই মাঝে হঠাৎ ‘সাদা মুখ আর উগ্র অসঙ্কোচ সৌন্দর্য দেখে মনটা বিরক্ত... বাঁধিগতের সীমা লঙ্ঘন করতে সাহস হয় না।’ জানতে ইচ্ছা হয়, চিঠি পড়ে কাদম্বরী মনে মনে হেসেছিলেন কি না!
ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর ১৮৮০ থেকে ’৮৪ সালের সময়টায় টেনশন জোরদার হয়। গঙ্গার ধারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, কাদম্বরী ও রবীন্দ্রনাথ। এমন সময় ঝড়। রবীন্দ্রনাথ গাইলেন, এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর। বউঠাকরুন শুনলেন, কিন্তু চুপ। ঝড় কি শুধু বাইরেই? নিঃসন্তান কাদম্বরী, নিচু ঘরের মেয়ে বলেও যাঁকে নানা খোঁটা সহ্য করতে হয়েছে, তাঁরও তো কিছু করার ছিল না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মেতে নাটকজগতে। কাদম্বরী বন্ধু-দেওর-সন্তান সব যাকে ভেবেছিলেন, সে অন্য ব্যস্ততায়। নিঝর্রের স্বপ্নভঙ্গ ঘটে গিয়েছে।
অনেকে চারু-অমলের কথা তুলবেন। আমি সাহিত্যের লোক নই। বরং ৬৯ বছর বয়সে রানি মহলানবিশকে লেখা একটা চিঠি আমাকে হন্ট করে। সেই সকালে রবীন্দ্রনাথের হঠাৎ মনে পড়েছে ছেলেবেলার স্মৃতি। জ্যোতিদার ভৃত্য ভোরবেলায় মাখন-টোস্ট তৈরি করছে। চিঠিতে লিখছেন, ‘আমি ছিলাম অনাদরের কূলে, সেখানে ফুল ছিল না, ফসল ছিল না... জ্যোতিদা ছিলেন নিবিড় ভাবে সত্য, তাঁর সংসার নিবিড় ভাবে তাঁর নিজের।’ নিঃসঙ্গতাবোধ, অন্যদের নিবিড় সম্পর্কে নিজেকে অনাহূত ভাবা, গিল্ট কমপ্লেক্স, সবই মিলেমিশে গিয়েছিল অবচেতনে। |