সম্পাদকীয়...
চক্ষুসংস্কৃতি
ই এক যুগ পড়িয়াছে, যখন প্রতি মুহূর্তেই আপনার মনে হইবে, কেহ বোধ হয় আপনার উপর নজর রাখিতেছে। চায়ের দোকানে বসিয়া আনমনে নাক খুঁটিতেছেন, ইহাও হয়তো কোনও মর্কট মোবাইলের ক্যামেরায় তুলিয়া লইতেছে ও অচিরে ইউ-টিউবে কমেডি-ক্লিপ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাইবে, আপনার চা শেষ হইবার পূর্বেই! লিফ্টে উঠিতে উঠিতে সঙ্গিনীকে স্বল্প আদরের চিন্তা তো ছাড়িয়া দিন। নিশ্চিত ভাবেই একটি ক্ষুদ্র ক্যামেরা আপনাদের কাণ্ড অবলোকন করিতেছে ও বিল্ডিং-এর প্রান্তে দুঁদে পাহারাদার পরদায় চক্ষু সাঁটিয়া নোলা সকসক করিতেছেন। অরওয়েলের ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’ বা সমাজতাত্ত্বিকগণের প্রিয় ‘প্যানঅপটিকন’ তত্ত্বে তীব্র ও সর্বাঙ্গীণ নজরদারিকে কর্তৃপক্ষের তুঙ্গ ক্ষমতার অঙ্গ হিসাবে দেখা হয়, রাষ্ট্রের চরম স্বৈরাচারের দ্যোতক হিসাবে উপস্থিত করা হয়। কিন্তু আমাদের বর্তমান সমাজে অতি বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে, নিতান্তই শান্তিকল্যাণ রাগে এই সর্বত্রগামী ও সর্বজ্ঞ চক্ষুসংস্কৃতির প্রচলন হইয়া গিয়াছে। কেহ নিজেকে অপমানিত মনে করে না, কেহ মনে করে না তাহার মৌলিক অধিকার খর্ব হইয়াছে, অথচ বিখ্যাত মানুষীর প্রেমিকের সহিত নিভৃত বিকিনি-স্নানে যাইবার জো নাই, সাধারণ মানুষেরও হোটেলের ঘরে নির্ভয় যৌনতা করিবার পাট উঠিয়াছে। শপিং মলে সকল অঞ্চলে পিলপিল করিতেছে ক্যামেরা। অফিসে ক্যামেরা, আবাসনে ক্যামেরা, পথেঘাটে জাগ্রত ক্যামেরা। কিছু নামী বিদ্যালয় ক্লাসরুমে ক্যামেরার বন্দোবস্ত করিয়াছেন, যাহাতে বেঞ্চির প্রতিটি ইঞ্চির উপর নিরীক্ষণ-আধিপত্য বজায় রাখা যায়। স্নোডেন-ঘটনা আসিয়া চক্ষে আঙ্গুল দিয়া দেখাইল, কোনও দেশের গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্যও ওস্তাদ-দেশের নজরদারির বাহিরে নহে, তাহাও বহু লোকের চোখ ও মনের গোচরীভূত হইতেছে। সামান্য ভাবিলেই বুঝা যায়, তবে তো আমার-আপনার ই-মেলে লেখা প্রেমপত্র, এসএমএস-এ অসভ্য তিরস্কারবাক্য, এমনকী হবু-প্রকাশককে প্রেরিত বৈপ্লবিক ই-পাণ্ডুলিপিখানিও সম্ভাব্য একশো জন পড়িয়াছে ও হাসিয়া খুন হইয়াছে। কে বলিতে পারে আপনার চরম ব্যক্তিগত চ্যাট-গুলি অন্য কোনও জমায়েতে উচ্চণ্ড গসিপ-এর চাট জোগাইতেছে কি না!
এই বিপন্ন পরিস্থিতিতে লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাস এক আশ্চর্য সিদ্ধান্ত লইল: সকল গোপন নথি আর কম্পিউটারে লিখিত হইবে না, টাইপরাইটারগুলিকে ধূলি ঝাড়িয়া নামাইতে হইবে, সনাতন পদ্ধতিতে কাগজে টাইপ করিয়া জরুরি তথ্য ফাইলবন্দি করা থাকিবে। জরুরি কথাবার্তাও দূতাবাসের ঘরের ভিতরে বলিলে, কোন যন্ত্র সেখানে লুকানো আছে, কোন সংস্থা আড়ি পাতিতেছে, তাহা লইয়া শঙ্কা বাড়িতেছে। তাই ঠিক হইল, কথাগুলি বাহিরে গিয়া বলিতে হইবে। হাই কমিশনার রসিকতা করিয়াছেন, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বাক্য বলিতে চেয়ার ছাড়িয়া বাগানে যাওয়া বড় ক্লান্তিকর। কিন্তু টাইপরাইটাররা নিশ্চয় অপ্রত্যাশিত পুনরুজ্জীবনে প্রবল আহ্লাদিত! নজরদারি এড়াইবার প্রকল্পে মানুষ যদি বর্তমান ডিজিটাল-অস্তিত্ব ছাড়িয়া কিছু মাত্রায় প্রাচীন অভ্যাসে ফিরিতে চায়, হয়তো সে আবার কাগজ আনিয়া খসখস করিয়া প্রেমপত্র লিখিবে, কোচিং ক্লাসে গ্রন্থমধ্যে চিরকুট লুকাইবে, এমনকী ঘরের অন্য প্রান্তের মানুষটির সহিত এসএমএস-চালাচালি না করিয়া, উঠিয়া গিয়া কথা বলিবে! হয়তো কিছু ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির ফোন নাম্বার সে স্মৃতিতে রাখিতে চেষ্টা করিবে, স্কাইপ-এ আড্ডা না জমাইয়া বন্ধুর বাড়ি যাইয়া সিঙাড়া খাইবে, এবং এই সকল অভ্যাস বাড়িতে বাড়িতে এক দিন সে সময় জানিবার জন্য মোবাইলের পরিবর্তে হাতঘড়ির দিকে তাকাইবে! প্রযুক্তি ও যুক্তি ইহা দেখিয়া হাঁ করিয়া থাকিলেও, নস্টালজিয়া-বিলাসী বাঙালি জাতির বড় উল্লাসের দিন সমাগত হইবে, এতগুলি খোকাবাবুর অলীক প্রত্যাবর্তন সে দিবাস্বপ্নেও রচনা করে নাই। এই আনন্দময় বিচিত্র বসুধায়, কাহারও সর্বনাশ হইলে, অন্য কাহারও পৌষমাস ঘটিতে বাধ্য।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.