|
|
|
|
অস্ত্র দৌড় থামাতে বলে বার্তা শরিফের, আজ কথা |
জয়ন্ত ঘোষাল • নিউ ইয়র্ক |
বৈঠকের ২৪ ঘণ্টা আগে দুই প্রধানমন্ত্রীর দুই মুখ। এক জন বললেন, আগে পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসের কারখানা বন্ধ হওয়া জরুরি। তিনি মনমোহন সিংহ। আর এক জন বললেন, এত দিন ধরে দুই দেশ অস্ত্র প্রতিযোগিতায় টাকা নষ্ট করেছে। সেটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। তিনি নওয়াজ শরিফ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে মাঝে মধ্যেই দেশে বিরোধীরা ‘দুর্বল’ বলে সমালোচনা করেন। এমনকী, জম্মুতে জঙ্গি হানার পরেও তিনি কেন পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে চাইছেন, তা নিয়েও অনেক কটাক্ষ করা হয়েছে। কিন্তু মনমোহন এ দিন দেখিয়ে দিলেন, কেন তিনি আলোচনা থামাতে চান না। বুঝিয়ে দিলেন, আলোচনার মাধ্যমে শুধু দু’দেশের পারস্পরিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হবে না, চাপ বাড়ানো হবে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের উপরেও। আর এই জোরটা তিনি আরও পেয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কথায়। ওবামা গত কালই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে বলেছিলেন, “পাকিস্তান কখন কী করে, বোঝা মুশকিল।”
মনমোহনের এই অবস্থান স্বাভাবিক। কিন্তু তাত্পর্যপূর্ণ হল একটি ভারতীয় সংবাদ চ্যানেলকে দেওয়া নওয়াজ শরিফের সাক্ষাত্কার। সেখানে তিনি শুধু মনমোহনের সঙ্গে বৈঠকে বসার ব্যাপারে আগ্রহই দেখাননি, বার্তা দিয়েছেন অস্ত্র দৌড় বন্ধ করারও। বলেছেন, “এত দিন আমরা পরমাণু অস্ত্র, ট্যাঙ্ক আর এফ-১৬ কিনে টাকা নষ্ট করেছি। ভারতও করেছে। এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়া দরকার। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতি দরকার, কিন্তু একটা সীমা পর্যন্ত। বরং যুদ্ধাস্ত্র কেনার টাকা সামাজিক উন্নয়নের খাতে ব্যয় হলে ভাল হতো।” |
|
রাষ্ট্রপুঞ্জে মনমোহনের বক্তৃতা। শনিবার। ছবি: এপি। |
কূটনীতিকদের একাংশ বলছেন, সেটা বাস্তবে সম্ভব কি না, শরিফের ইচ্ছেমতো দুই দেশ এফ-১৬ কিনে অর্থের অপচয় করা বন্ধ করবে কি না, এই সব প্রশ্নের থেকেও বড় কথা হল, সদর্থক ও উষ্ণ বার্তা দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তবে ভারত খুব আশাবাদীও নয়। দিল্লির একটাই বক্তব্য, এখন আলোচনা প্রক্রিয়াটা চলুক। এত কিছু নিয়ে এখনই ভাবার প্রয়োজন নেই।
বস্তুত, মনমোহন বারবারই বুঝিয়ে এসেছেন, মিশরের শর্ম-অল-শেখের শীর্ষ বৈঠকে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার যে রাস্তা খোলা হয়েছিল, তা থেকে তিনি সরে আসতে চান না।
কারণ, সরে এলে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। তাতে সুবিধা হবে সে দেশের সেনাবাহিনী, আইএসআই এবং মৌলবাদীদেরই। দিল্লি এ-ও জানে, শরিফ যতই সদিচ্ছা দেখান না কেন, দেশে অভ্যন্তরীণ নানা বাধার ফলেই তিনি খুব বেশি দূর এগোতে পারবেন না।
আজ রাষ্ট্রপুঞ্জের বক্তৃতায় মনমোহন কঠোর অবস্থানই নিয়েছেন। সাফ জানিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বকেয়া বিষয়গুলির নিষ্পত্তির জন্য পাক মাটিতে সন্ত্রাসের কারখানা বন্ধ হওয়া দরকার। রাখঢাক না করেই বলেছেন, ভারতীয় উপমহাদেশ এলাকায় সন্ত্রাসের ভরকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে পাকিস্তান। রাষ্ট্রের মদতে চলা সন্ত্রাস ভারতের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে বলেছেন, “অগ্রগতির জন্য যেটা প্রয়োজন তা হল, পাক-শাসিত এলাকা যাতে ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসে ব্যবহার না হয়, সেটা দেখা।”
মনমোহন কঠোর বার্তা দিয়েছেন কাশ্মীর নিয়েও। বলেছেন, জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অখণ্ডতার প্রশ্নে ভারত কোনও আপস করবে না। এ-ও বলেছেন, “শিমলা-চুক্তির উপর ভিত্তি করেই আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর-সহ বকেয়া সমস্ত বিষয়ের নিষ্পত্তি করতে চায় ভারত।”
ঘটনাচক্রে, আজ শরিফ কিন্তু নিয়ন্ত্রণরেখা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে একটি যৌথ মেকানিজম তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন। সেই মেকানিজম জম্মুর ঘটনার তদন্তও করতে পারে বলে মনে করেন তিনি। পাক প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব, দুই দেশের বিদেশসচিব এবং ডিরেক্টর জেনারেল মিলিটারি অপারেশনস-রা এ নিয়ে বৈঠকে বসুন। সূত্রের খবর, কাল মনমোহনের সঙ্গে বৈঠকেও শরিফ সেই প্রস্তাব দেবেন। তবে ভারত কী অবস্থান নেবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হওয়ার পরে শরিফ বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়টি ১৯৯৯ সালে তিনি যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকেই আবার শুরু করতে চান। আজকের সাক্ষাত্কারেও ফের সে কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন, “মনমোহন সিংহ এক জন ভাল মানুষ। আমি ওঁকে চিনি, উনি আমাকে চেনেন। ভোটের ফল বেরোনোর পর উনি আমাকে ফোন করেছিলেন। ওঁকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। উনি আমাকে ভারতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই প্রথম ওঁর সঙ্গে বৈঠক হবে। বকেয়া সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই।”
ইতিমধ্যে গত কাল মনমোহনকে বাড়তি অক্সিজেন জোগান ওবামা। গত কাল মনমোহনের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সময় বিদেশসচিব সুজাতা সিংহ, আমেরিকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত নিরুপমা রাও, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের মতো সব প্রতিনিধির সামনেই ওবামা বলেন, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় ভারতকে সব রকম সাহায্য করতে তৈরি আমেরিকা। এত দিন ভারত দেখে এসেছে, আমেরিকার পাক নির্ভরতা। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের মুখে দাঁড়িয়ে যেটা ক্রমশই বেড়েছে। তাই পাকিস্তান নিয়ে ভারত এত দিন যে সমস্যার কথাগুলো বলত, তা নিয়ে বিশদে আলোচনা করতে চাইত না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু এ বার ওবামা মধ্যাহ্নভোজনে গল্পের ফাঁকেই বলে উঠেছেন যে, পাকিস্তান সম্পূর্ণ ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ হয়ে গিয়েছে।
গত কালের সেই বৈঠকে ওবামাকে মনমোহন এ-ও জানিয়েছেন, সীমান্ত পারের সন্ত্রাস নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামিকালের বৈঠক থেকে তিনি খুব বেশি কিছু আশা করছেন না। কাজেই মনে করা হচ্ছিল, পাকিস্তান থেকে কী ভাবে ভারতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালানো হচ্ছে, কী ভাবে পাকিস্তানের মধ্যেই একটা অংশ সন্ত্রাসবাদের ভরকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, সে সবই শরিফকে খুব বিশদে বলবেন প্রধানমন্ত্রী।
ভারত ও আমেরিকা গত কাল প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চুক্তি করেছে। সন্ত্রাস দমনে যৌথ ব্যবস্থার কথাও বলেছে। এই বিষয়টি লিখিত চুক্তিতেও বলা হয়েছে। কিন্তু ওবামা যে ভাবে পাকিস্তান নিয়ে কড়া ভাষায় কথা বলেছেন, তা ভারতের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। ওবামা লস্কর-ই-তইবার প্রসঙ্গ তুলেছেন। বিশ্ব জুড়ে লস্করকে নিয়ে আশঙ্কার কথাও বলেছেন। জম্মুর জঙ্গি হানারও নিন্দা করেছেন তিনি।
এমনই এক পরিস্থিতিতে হতে চলেছে শরিফ-মনমোহন বৈঠক। শরিফের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যা শেষ পর্যন্ত নিছক শীতল করমর্দনে পর্যবসিত হবে না বলেই আশা করা হচ্ছে। কারণ, আর যা-ই হোক, শূন্যের চেয়ে এক অন্তত বড়! |
পুরনো খবর: শরিফ-বৈঠক বাতিলে নারাজ মনমোহন |
|
|
|
|
|