|
|
|
|
ডেঙ্গির থাবা এড়াতে উত্তরের যাত্রীদের রক্তপরীক্ষা কলকাতায় |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
কলকাতা ভুগেছিল গত বছর। এ বার শিলিগুড়ি। ডেঙ্গির দাপটে গোটা শিলিগুড়ি শহর আতঙ্কগ্রস্ত। তিন মাসে ওই শহর জুড়ে ডেঙ্গিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৬০০ ছাড়িয়েছে। মৃত্যুও হয়েছে ছ’জনের।
চিকিৎসকেরা বলছেন, ঠিক সময়ে রোগ ধরা পড়লে এবং চিকিৎসা শুরু হলে বিপদের আশঙ্কা নেই। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গ প্রকট হওয়া সত্ত্বেও রক্ত পরীক্ষা না-করানোয় ঠিক সময়ে রোগ ধরা পড়ছে না। এর ফলেই উত্তরবঙ্গের ওই প্রধান শহরে ডেঙ্গি মারাত্মক হয়ে উঠেছে বলে পরজীবী বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
শিলিগুড়ির বিভিন্ন হাসপাতালে ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা। এ বার কলকাতায় ডেঙ্গি এখনও সে-ভাবে ছড়ায়নি। কিন্তু প্রতিদিন শিলিগুড়ি থেকে বহু মানুষ নানা কাজে এই শহরে আসেন। তাঁদের মধ্যে জীবাণু বয়ে আনা লোকজন যে-কোনও সময়ে মহানগরীতে ডেঙ্গি সংক্রমণের কারণ হতে পারেন। যে-এডিস ইজিপ্টাই মশা ডেঙ্গির জীবাণু বহন করে, তারাও মহানগরের বাসিন্দা। এই অবস্থায় শিলিগুড়ির সংক্রমণ যাতে কলকাতায় থাবা বসাতে না-পারে, তার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে কলকাতা পুরসভা।
কী সেই ব্যবস্থা?
মেয়র-পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ বৃহস্পতিবার বলেন, “মেডিক্যাল ক্যাম্প হবে শিয়ালদহ ও কলকাতা স্টেশনে। শিলিগুড়ি এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে এসে যাঁরা ওই সব স্টেশনে নামবেন, তাঁদের রক্ত পরীক্ষা করা হবে।” আজ, শুক্রবার থেকেই উত্তরবঙ্গ হয়ে আসা ১১টি ট্রেনের যাত্রীদের রক্তপরীক্ষার জন্য ওই দু’টি স্টেশনে শিবির বসাচ্ছে কলকাতা পুরসভা। কিন্তু উত্তরবঙ্গের যে-সব ট্রেন হাওড়ায় আসে, সেগুলির যাত্রীদের ক্ষেত্রে কী হবে? অতীনবাবু বলেন, ওই স্টেশন এলাকা হাওড়া পুরসভার এক্তিয়ারভুক্ত। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর যা করার করবে। তবে স্বাস্থ্য দফতরের তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই বলে স্বাস্থ্য ভবনের খবর। কলকাতা ও সল্টলেক পুরসভা অবশ্য ওই রোগ ঠেকানোর চেষ্টায় ঢিলে দিতে রাজি নয়। তারা বাড়ি বাড়ি ডেঙ্গি-সমীক্ষা শুরু করেছে।
তবে ডেঙ্গি নিয়ে যে-ভাবে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, তা অমলূক বলে মনে করেন পরজীবী বিশেষজ্ঞদের অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, অযথা আতঙ্কিত না-হয়ে সতর্ক হলেই ভাল হয়। ঠিক সময়ে চিকিৎসক দেখিয়ে ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়ে যায়। |
মরসুমের রোগ ডেঙ্গি কথা |
রোগটা কী? |
ডেঙ্গি ভাইরাস বহনকারী এডিস প্রজাতির মশা
কামড়ালে ডেঙ্গি হয়। এডিস মশা এই রোগ
এক জনের থেকে অন্যের শরীরে ছড়ায়। |
|
উপসর্গ কী? |
|
• জ্বর প্রথমে কম। পরে হঠাৎ বেড়ে যায়।
• মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা, চোখের পিছনে ও গাঁটে ব্যথা।
• গায়ে লাল লাল দাগ, চোখ লাল।
• অনেক সময় পেটে অসহ্য যন্ত্রণা, বমি।
• শরীর থেকে রক্তপাত।
• দেহে জলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় দুর্বলতা |
কী ভাবে রোগ ধরা পড়ে? |
উপসর্গ মিললেই রক্ত পরীক্ষা করিয়ে
নেওয়া দরকার। এক বার রক্তপরীক্ষায়
জীবাণু ধরা না-পড়লে দ্বিতীয় বার
পরীক্ষা করানো উচিত। |
|
মৃত্যুভয় কতটা? |
ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হলে হেমারেজিক ডেঙ্গি (যেখানে শরীর থেকে রক্তপাত হয়) মৃত্যু ঘটাতে পারে। |
রোগ প্রতিরোধ সম্ভব কি? |
মশা নিয়ন্ত্রণই একমাত্র প্রতিরোধ। এই রোগের প্রতিষেধক বেরোয়নি।
|
মশা নিয়ন্ত্রণের উপায় কী? |
|
এডিস মশা ডিম পাড়ে পরিষ্কার জলে।
ফুলদানি
বা এয়ারকুলারের অল্প জলেও ডিম পাড়ে তারা।
তাই জল জমতে দেওয়া চলবে না। |
চিকিৎসা কী ভাবে? |
চিকিৎসকের পরামর্শে
প্যারাসিটামল খেতে হয়।
প্রচুর জলপান। |
|
|
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, যে-ডেঙ্গির প্রকোপে শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্তপাত শুরু হয়, সেই হেমারেজিক ডেঙ্গির সংক্রমণে ঠিক সময়ে রক্ত না-দিলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। যথাসময়ে চিকিৎসা শুরু না-হলে বহু ক্ষেত্রে সাধারণ ডেঙ্গিও জটিল হয়ে মৃত্যু ঘটায়। ডেঙ্গি ভাইরাসের জিনগত পরিবর্তন হয় নিয়মিতই। তাই অনেক সময় ডেঙ্গি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লেও উপসর্গের দেখা বিশেষ মেলে না। অনেক ক্ষেত্রে একসঙ্গে শরীরের একাধিক অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ। তাতে পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়।
এই অবস্থায় কোন পদ্ধতিতে ডেঙ্গির চিকিৎসা হবে, তা নিয়ে শিলিগুড়িতে বিভ্রান্তির শেষ নেই। কলকাতার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ (নাইসেড)-এর অধিকর্তা শেখর চক্রবর্তী জানান, ডেঙ্গির স্বাভাবিক উপসর্গ থাকলে বাড়িতেই রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। তবে অণুচক্রিকা কী হারে কমছে-বাড়ছে, তার উপরে নজর রাখা জরুরি।
স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা, পরজীবী বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী ডেঙ্গি চিকিৎসায় তাঁর ৩০ বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ডেঙ্গির জন্য পাঁচ ধরনের উপসর্গ-ভিত্তিক চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলি হল:
• জ্বর, হাতে-পায়ে-চোখে ব্যথা, মাথাব্যথা, বমি, শরীরের লাল লাল ছোপ। এগুলো ডেঙ্গির প্রাথমিক উপসর্গ। এর সঙ্গে সঙ্গে রক্তপরীক্ষায় ডেঙ্গির জীবাণু পেলে দেখতে হবে, রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা কত। সেটা এবং রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণগুলি মোটামুটি ঠিক থাকলে রোগীকে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করা যায়। তবে অণুচক্রিকার হিসেব রেখে যেতে হবে নিয়মিত। প্যারাসিটামল এবং প্রচুর পরিমাণে জলই মূল দাওয়াই।
• রোগীর পাতলা পায়খানা শুরু হলে, হেপাটাইটিস হয়ে গেলে, শরীরে জলের পরিমাণ কমে গেলে স্যালাইন দিতে হবে। সে-ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি করাই ভাল।
• অণুচক্রিকা দ্রুত কমতে থাকলে, রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণের পরিমাণ অনেকটা কমে গেলে, শ্বেতকণিকা কমে গেলে (এক হাজার থেকে দেড় হাজারে নেমে এলে), পেটে-বুকে জল জমলে, রক্তের অ্যালবুমিন কমতে থাকলে হাসপাতালে নিয়ে যথাযথ চিকিৎসা শুরু করা উচিত। এ ক্ষেত্রে রোগীকে অণুচক্রিকা দিতে হয়।
• হেমারেজিক ডেঙ্গিতে নাক, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত বেরোয়। চোখে লালচে ছাপ পড়ে। মেয়েদের ক্ষেত্রে অসময়ে ঋতুচক্র শুরু হয়ে যায়। মল ও মূত্রের সঙ্গেও রক্ত বেরোতে শুরু করে। এ-সব ক্ষেত্রেও হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। রোগীকে রক্ত এবং অণুচক্রিকা দিতে হয়।
• দেরিতে রোগ ধরা পড়লে অনেক সময় রোগী অচৈতন্য হয়ে পড়তে পারেন। সে-ক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
|
|
|
|
|
|