শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘেরাও রুখতে রাজ্যপাল কড়া দাওয়াইয়ের কথা বলেছেন মঙ্গলবার। কিন্তু ছাত্র নেতাদের মধ্যে তার যে বিশেষ প্রভাব পড়েনি, বুধবার তার প্রমাণ দিল রাজ্যের দুই শহরের দুই কলেজ। মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর ও নদিয়ার শান্তিপুর। শুধু তা-ই নয়, ঘেরাও থেকে মুক্তি পেতে জঙ্গিপুর কলেজের অধ্যক্ষ শেষমেশ তালা লাগালেন ফটকে। জানিয়ে দিলেন, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত না-হওয়া পর্যন্ত কলেজ গেটের তালা তিনি খুলবেন না। র্যাগিংয়ের অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত ছাত্রদের শাস্তি মকুবের দাবিতে ক’দিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে টানা ৫০ ঘণ্টা ঘেরাও করে রাখা হয়েছিল। প্লেসমেন্ট সেল পুনর্গঠনের দাবিতে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে সোমবার রাতভর আটকে রাখা হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার ও বিজ্ঞান-সচিবকে। ঘেরাও তুলতে দুই বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ সক্রিয় না-হওয়ায় ক্ষুব্ধ আচার্য তথা রাজ্যপাল মঙ্গলবার দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের ডেকে পাঠিয়ে নিজের ক্ষোভের কথা জানিয়েও দেন। ঘেরাও রুখতে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। |
এবং ঘেরাও থেকে পরিত্রাণ পেতে জঙ্গিপুর কলেজের অধ্যক্ষ যে পন্থা নিয়েছেন, সেটা ওই ‘কড়া পদক্ষেপের’ই অঙ্গ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। কেন তিনি কলেজে তালা লাগালেন?
অধ্যক্ষ আবু এল শুকরানা মণ্ডলের বক্তব্য, ভর্তি নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো গত দু’সপ্তাহ ধরে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। রোজই পালা করে এসএফআই, ছাত্র পরিষদ (সিপি) এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) কর্মী-সমর্থকরা কলেজে ঢুকে ছাত্রভর্তির দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। মঙ্গলবার ছাত্র পরিষদ সমর্থকেরা (অধ্যক্ষের দাবি, তাঁদের মধ্যে বহিরাগতেরাও ছিলেন) কলেজে গিয়ে তিন ঘণ্টা ‘ছাত্র ভর্তি কমিটির’ দুই শিক্ষক-সদস্যকে ঘেরাও করে রাখে। “প্রশাসনকে বারবার জানিয়েও বহিরাগতদের কলেজে ঢোকা আটকানো যাচ্ছে না। আমি অসুস্থ হয়ে বাড়িতে। অন্য কোনও শিক্ষক কলেজের দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। বাধ্য হয়ে নোটিস পাঠিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কলেজ বন্ধ করে দিয়েছি।” এ দিন বলেন অধ্যক্ষ।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিবিধ কারণে (কোথাও ছাত্রভর্তি, কোথাও প্লেসমেন্ট, কোথাও বা শাস্তিপ্রাপ্ত পড়ুয়াদের শাস্তি মকুবের দাবিতে) যে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েও কলেজ- গেটে তালা লাগানোকে সমর্থন করতে পারছেন না কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। তাঁর কথায়, “ওখানে ঠিক কী হয়েছে, জানি না। ছাত্রছাত্রীদের গণতান্ত্রিক ভাবে দাবি পেশের অধিকার রয়েছে। কখনও
চাইব না, ছাত্রছাত্রীরা আইন হাতে তুলে নিক। আলোচনার মাধ্যমে আইন বলবৎ করতে হবে। কিন্তু তালা লাগানোটা সমাধান নয়।” টানা পঞ্চাশ ঘণ্টা ঘেরাওয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্ত-ও ঘেরাও প্রতিরোধে ‘জঙ্গিপুর মডেল’ মানতে পারছেন না। তাঁর মতে, “এটা কোনও হারজিতের খেলা নয়। আন্দোলনকারীরা সবাই ছাত্র। আন্দোলনের যৌক্তিকতা না-থাকলেও তাঁদের বোঝানো উচিত। ছাত্রেরা ঘেরাও করল বলে আমি পাল্টা কলেজের গেটে তালা ঝোলাব, এটা সমর্থন করি না।” জঙ্গিপুর কলেজ যার আওতায়, সেই কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার জুড়ানকৃষ্ণ সরখেলও তালা-কাণ্ডের খবরে বিস্মিত। “কলেজ বন্ধ করার কথা অধ্যক্ষ আমাদের কিছুই জানাননি। পঠনপাঠনের বিষয়টি তাঁর মাথায় রাখা উচিত ছিল। কলেজ বন্ধ করা ঠিক হয়নি।” বলেন তিনি।
শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি (বেসু)-র উপাচার্য অজয়কুমার রায় অবশ্য ঘটনার সরাসরি বিরোধিতা করেননি। তাঁর যুক্তি, “কর্তৃপক্ষ কী করবেন, তা পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল।” তবে ঘেরাও, ছাত্র-বিক্ষোভ রুখতে নিজের প্রতিষ্ঠানে যে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তাই অন্যতম কার্যকর সিদ্ধান্ত বলে অজয়বাবুর দাবি। তিনি বলেন, “পড়ুয়াদের অরাজনৈতিক ফোরামে যুক্ত করতে পারলে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানো সহজ হবে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তা বলতে পারি।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা নিয়ে সরব হয়েছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় ও লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। এ দিন প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কারপ্রদানের এক অনুষ্ঠানে অশোকবাবু বলেন, “বহু বাধা পেরিয়ে প্রতিবন্ধী পড়ুয়ারা এগিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে সুস্থ, সবল পড়ুয়ারা প্রভাবশালী শক্তির প্রভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে।” সোমনাথবাবু বলেন, “স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের নিগ্রহ করা হচ্ছে। একটা বুকচাপা অন্ধকারের পরিবেশের মধ্যে চলতে হচ্ছে।” জঙ্গিপুর কলেজের অধ্যক্ষও জানান, এই ‘অন্ধকার পরিবেশ’ থেকে বেরোতেই তিনি কলেজের গেটে তালা লাগিয়েছেন।
প্রাক্তন ছাত্রনেতারা অবশ্য তাঁর সিদ্ধান্তের প্রশ্নে একমত নন। নকশালপন্থী প্রাক্তন ছাত্রনেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “তালা মারাটা পদ্ধতি নয়। অধ্যক্ষেরা ওই পথ নিচ্ছেন উপায়ান্তর না-দেখে। আদর্শের অভাবে ছাত্রসমাজের মধ্যে বহিরাগত লুম্পেনরা জায়গা করে নিচ্ছে।” এসএফআইয়ের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সৈফুদ্দিন চৌধুরীর মন্তব্য, “অধ্যক্ষ অসহায় হয়েই তালা লাগিয়েছেন।” তৃণমূলের বিধায়ক তথা ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তাপস রায়ের অভিমত, “তালা মারাটা পদ্ধতি হতে পারে না। আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হলে পুলিশ-প্রশাসনকে খবর দেওয়াই ভাল।” |
কী বলছেন প্রাক্তন ছাত্রনেতারা |
|
সরকার যদি আরাবুল-মুন্নাদের দিয়ে কলেজ চালাতে চায়, তা হলে অনেক কলেজেই তালা ঝুলবে।
শমীক লাহিড়ী | প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, এসএফআই |
|
|
তালা মারাটা পদ্ধতি নয়। আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হলে পুলিশ-প্রশাসনকে খবর দেওয়াই ভাল।
তাপস রায় | প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি, ছাত্র পরিষদ |
|
|
অধ্যক্ষরা এই পথ নিচ্ছেন উপায়ান্তর না দেখে। ছাত্রসমাজেও লুম্পেনরা জায়গা করে নিচ্ছে।
অসীম চট্টোপাধ্যায় | প্রাক্তন নকশাল ছাত্রনেতা |
|
|
অধ্যক্ষরা অসহায়। দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্যে স্বার্থান্বেষীদের হাতিয়ার হওয়াটা ছাত্রছাত্রীদের কাজ নয়।
সৈফুদ্দিন চৌধুরী| প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক, এসএফআই |
|
|
এতে সরকারের দুর্বলতা প্রকট হচ্ছে। শাসক-বিরোধী দু’পক্ষকেই পরিবেশ উদ্ধারে সচেষ্ট হতে হবে।
মানস ভুঁইয়া | প্রাক্তন নেতা, ছাত্র পরিষদ |
|
চাপের মুখে পড়েও জঙ্গিপুরের অধ্যক্ষ শুকরানা মণ্ডল জানিয়েছেন, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিরাপত্তার উপযুক্ত ব্যবস্থা না-হলে কলেজ-গেটের তালা খুলবেন না। অচলাবস্থা কাটাতে এ দিন জঙ্গিপুরের মহকুমাশাসক অরবিন্দকুমার মিনা কলেজের পরিচালন সমিতি ও শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। অধ্যক্ষকে কলেজ খোলার অনুরোধ জানিয়ে প্রশাসনের তরফে চিঠি পাঠানো হয়। তাতে মহকুমাশাসক জানান, বৃহস্পতিবার কলেজ না-খুললে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। সে চিঠি পেয়েও অধ্যক্ষ নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি।
শান্তিপুর কলেজের কর্তৃপক্ষ ঘেরাও এড়াতে এ দিন বিশেষ কোনও ‘কড়া ব্যবস্থা’র পথে যাননি। কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে টিএমসিপি-র শহর সভাপতি মনোজ সরকার ও তাঁর দলবল এ দিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে দুপুর থেকে ঘেরাও করেছিলেন। তাঁদের দাবি মেনে নিলে ঘেরাও ওঠে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ চয়ন ভট্টাচার্য বলেন, “আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করেছি।” জঙ্গিপুরের অধ্যক্ষের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
গত ক’দিন ধরে ধুলিয়ান কলেজেও ছাত্রভর্তি ঘিরে অশান্তি চলছে। অধ্যক্ষকে ছাত্রেরা ঘেরাও করে। অধ্যক্ষ অমিত ভৌমিক বলেন, “২৭ সেপ্টেম্বর পরিচালন সমিতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। আশা করি, আলোচনায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।” |