দেড় মাসের শিশুটির লালন-পালনের দায়িত্ব পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছিলেন বছর বাইশের তরুণী। বাচ্চা মানুষ করার তাগিদে বিয়েও করেননি। সন্তান স্নেহে সেই শিশুকে বড় করেছেন। ন’বছর বাদে হঠাৎই হাজির শিশুটির জন্মদাত্রী!
এক দিন যে শিশুকে স্বেচ্ছায় ছেড়ে গিয়েছিলেন, তাকেই এখন নিজের কাছে ফেরাতে চান ওই মহিলা। পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন এ জন্য। আইন কার পক্ষে, তার বিচার করবে আদালত। তবে মা বলে এত দিন জেনে এসেছে যাঁকে, তাঁকে ছেড়ে যেতে হতে পারে জানতে পেরে দিনভর কেঁদে ভাসিয়েছে ৯ বছরের সেই ছেলে। এক দিকে আইন, অন্য দিকে আবেগের এই টানাপোড়েনের সাক্ষী থেকেছে বারাসত থানা। সমাজকল্যাণ দফতরের নির্দেশে অবশ্য হাসিমুখে আপাতত পালিকা মায়ের কাছেই ফিরেছে ছেলেটি। পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে আদালত। |
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর ন’য়েক আগে বারাসতের রামকৃষ্ণপুরে বাড়ি ভাড়া নেন অবাঙালি এক দম্পতি। কিছু দিনের মধ্যেই গর্ভবতী স্ত্রীকে রেখে বাড়ি ছাড়েন স্বামী। তারপর থেকে সেই মহিলার দেখভালের দায়িত্ব নেন বাড়িওয়ালার তরুণী মেয়ে। জন্ম নেয় শিশুপুত্র। তার মাকে বারাসত হাসপাতালে ভর্তি করা থেকে শুরু করে শিশুর প্রাথমিক রক্ষণাবেক্ষণ সবই হাসিমুখে সামলেছেন ওই তরুণী। মাস দেড়েকের মাথায় ছেলেকে ওই তরুণীর কাছে রেখেই দেহরাদূন চলে যান তার জন্মদাত্রী মা। বারাসত থানায় এ দিন তিনি দাবি করেছেন, কাজের খোঁজেই শিশুপুত্রকে ছেড়ে যেতে হয়েছিল দেহরাদূনে। মাঝে মধ্যে এসে খোঁজও করেছেন। কিছু কিছু টাকাও দিয়েছেন। ফলে ছেলেকে ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সেই ছেলে অবশ্য জানিয়েছে, তার এই ‘মা’-কে সে কখনও চোখেই দেখেনি।
পালিকা মায়ের দাবি, শিশুটির জন্মদাত্রী তাঁকে সে সময়ে জানিয়েছিলেন, স্বামী তাঁকে প্রতারণা করেছেন। ছেলের প্রতিপালন তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। অন্য এক পুরুষের সঙ্গে দেহরাদূনে যেতে চান তিনি। কিন্তু বাচ্চাটিকে কাছে রাখার ব্যাপারে আপত্তি আছে তাঁর পুরুষ সঙ্গীটির।
এই ক’বছরের মধ্যে ছেলের খোঁজ করতে আসেননি ওই মহিলা, দাবি পালিকা মায়ের। টাকা দেওয়ার অভিযোগও উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। বাড়ির সামনেই একটি কাপড়ের দোকান করে ছেলের ভরণপোষণ চালান ওই তরুণী। ছেলেটি
পড়ে বারাসতেরই একটি নামী স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে।
তবে আইনজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এ ভাবে ওই শিশুর উপরে আইনি অধিকার জন্মায় না পালিকা মায়ের। এ ভাবে কোনও শিশুর দায়িত্বও তুলে দেওয়া যায় না কারও হাতে। ভুল করেছেন দু’জনই। নিয়ম অনুযায়ী, শিশুটিকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সমাজকল্যাণ দফতরের কাছে। সেখান থেকে শিশুটিকে পাঠানোর কথা কোনও হোমে। পরে আদালতে আবেদন করে আইনি প্রক্রিয়া সমাধানের পরেই ওই শিশুটিকে দত্তক নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এক বার হোমে পাঠানো হয়ে গেলে ওই শিশুটিকেই যে দত্তক নেওয়া যাবে, তার কী নিশ্চয়তা? কারণ, দত্তক নেওয়ার জন্য তো দীর্ঘ লাইন থাকে হোমগুলিতে। আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, সে ক্ষেত্রে আদালতের কাছে আবেদনে উল্লেখ করা যেতে পারে, নির্দিষ্ট ওই শিশুটিকেই দত্তক নিতে ইচ্ছুক কেউ। তা হলে আইনের বাধা থাকে না।
বারাসতের শিশুটির পালিকা মা জানাচ্ছেন, এ সব আইন-কানুনের কিছুই জানা ছিল না তাঁদের। এ নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিতে পারে, তা-ও মাথায় আসেনি। বারাসত আদালতের এক আইনজীবীর কথায়, “বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ভুলই করেন পালক দম্পতি। তাঁরা মনে করেন, কারও কাছ থেকে পাওয়া কোনও শিশুর উপরে স্বাভাবিক অধিকার জন্মায়। কিন্তু স্নেহের সেই অধিকার আইনের চোখে স্বীকৃত নয়। সে জন্যই ভবিষ্যতে জটিলতা দেখা দিতে পারে।”
এ ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নিতে পারে আদালত? আইনজীবীদের একাংশ জানাচ্ছেন, বাচ্চাটির যেহেতু জ্ঞান-বুদ্ধি হয়েছে, সে ক্ষেত্রে তাকেই আদালতে জিজ্ঞাসা করা হতে পারে, কার কাছে থাকতে চায়। সে যা চাইবে, তা-ই করা হবে। তবে জন্মদাত্রী বাবা-মা নিয়মিত দেখা করতে পারেন তার সঙ্গে। সেই কারণেই এ দিন ছেলেটিকে পালিকা মায়ের কাছেই পাঠানো হয়েছে।
সোমবার প্রাক্তন স্বামীকে নিয়েই ছেলেকে নিতে বারাসতে হাজির হন বাচ্চাটির জন্মদাত্রী মা। পালিকা মা তাতে রাজি না হওয়ায় থানার দ্বারস্থ হন ওই দম্পতি। বুধবার থানায় ডেকে আনা হয় সব পক্ষকে। ছেলেটি পালিকা মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, সে এই মায়ের কাছেই থাকতে চায়। পুলিশ খবর দেয় জেলা সমাজকল্যাণ দফতরে। ওই দফতর জানায়, বারাসত আদালতেই এই মামলার বিচার চলবে। যতদিন তার নিষ্পত্তি না হয়, তত দিন পালিকা মায়ের কাছেই থাকবে ছেলেটি। ওই দম্পতি চাইলে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। আইনজীবী শান্তময় বসু বলেন, “এ ভাবে নিজের ছেলেকে মা কাউকে দিয়ে দিতে পারেন না। কেউ এ ভাবে কোনও বাচ্চাকে কেউ নিতেও পারে না।”
এ দিন বারাসত থানায় পালিকা মায়ের কোলে মুখ গুঁজে মাঝে মাঝেই ডুকরে কেঁদে উঠেছে ছেলেটি। চোয়াল শক্ত করে আবেগ সামাল দিয়েছেন পালিকা মা। ছেলেটি যখন জানল চেনা বাড়িতেই ফিরবে সে, তখন তার মুখে একগাল হাসি। কিন্তু, ‘ছেলে’কে নিয়ে থানা ছাড়ার সময় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি পালিকা মা। |