চার দিন ধরে চলা গুলির লড়াই থামল মঙ্গলবার রাতে। কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াট্টা ঘোষণা করলেন, ওয়েস্টগেট শপিং মল জঙ্গিমুক্ত। বললেন, “এই হামলার জন্য আমরা লজ্জিত। যা ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তা অপূরণীয়। কিন্তু আমাদের তরফে যতটা সম্ভব আমরা করেছি। সারা বিশ্ব দেখেছে, কী ভাবে লড়েছি আমরা। এই ধ্বংস-হত্যা-যন্ত্রণার ভার সারা দেশকেই বইতে হবে। খুনিরা সাজা পাবেই, পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন।” বুধবার থেকে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হবে কেনিয়ায়।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, চার দিনের গুলিযুদ্ধে পাঁচ জন জঙ্গি নিহত। আহত ১১ জন কেনীয় সেনা-সহ প্রায় ২০০ জন। উদ্ধারকারী দল ২০০ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেছে বলে সরকারি সূত্রের খবর। সেই সঙ্গেই চলছে মলের ভিতর থেকে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া মৃতদেহগুলি বার করার কাজ। |
সদ্য জঙ্গিমুক্ত হয়েছে ওয়েস্টগেট শপিং মল। জয়ের ইঙ্গিত কেনীয় সেনাদের। ছবি: এএফপি। |
ছ’জন নিরাপত্তারক্ষী-সহ নিহতের সংখ্যা ৬৯-এ এসে থেমেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন তিন জন ভারতীয়ও। বছর চল্লিশের শ্রীধর নটরাজন ও আট বছরের শিশু পরমশু জৈনকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল গত কালই। আজ জানা গিয়েছে, সুদর্শন বি নাগরাজ (৫০) নামে বেঙ্গালুরুর এক ব্যক্তিও নিহত।
সুদর্শনের দাদা রাম প্রসাদ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর দেহ দেশে পৌঁছবে। তিনি বলেন, “দিলীপকুমারের ভক্ত ছিল ভাই। শেষ ক’দিন নিয়মিত খোঁজ নিত অসুস্থ দিলীপকুমারের শারীরিক অবস্থার। উনি সুস্থ হচ্ছেন জেনে খুব আনন্দ পেয়েছিল ভাই।” তাঁর আক্ষেপ, “রবিবারই ব্যবসার কাজে উগান্ডা চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগের দিন কেনাকাটা করতে গিয়েই...।” ভারতীয় দূতাবাস জানিয়েছে, সুদর্শনের কপালে, বুকে, হাতে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় হয়ে গিয়েছে একাধিক গুলি।
নিহতদের তালিকায় ভারতীয়দের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জঙ্গি হানায় জড়িতদের গ্রেফতার করার জন্য দেশ জুড়ে তৎপরতা তুঙ্গে। কেনিয়ার বিমানবন্দর এবং সীমান্ত এলাকাগুলিতে কড়া তল্লাশি চলছে। অভ্যন্তরীণ মন্ত্রক জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই ১১ জন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
লড়াই থামার আশ্বাস মিলেছিল আজ সকাল থেকেই। কিন্তু দিনভর চলতে থাকা গুলির শব্দে আশ্বাসকে ছাপিয়ে আতঙ্কই প্রকট হয়ে উঠেছিল নাইরোবির ওয়েস্টগেট শপিং মলের আশপাশের এলাকায়। চার দিন ধরে চলতে থাকা মৃত্যুমিছিল আরও দীর্ঘ হওয়ার আতঙ্ক।
মঙ্গলবার সকালেই কেনিয়ার অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের তরফে জানানো হয়, “এ বার লড়াই শেষের দিকে।” কিন্তু অন্য এক সরকারি সূত্রে জানা যায়, চার দিনের লড়াইয়ের পরেও এখনও কয়েক জন বন্দুকবাজ ধরা পড়েনি। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তা।
এ দিন কেনিয়ার বিদেশমন্ত্রী জানান, জঙ্গিদের মধ্যে বেশ কয়েক জন মার্কিন যুবক ছিল। কারও বয়সই ১৮ থেকে ২০-এর বেশি নয়। ছিল এক ব্রিটিশ মহিলাও। মলের ভিতরের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সেই সন্দেহজনক মহিলাকে সামান্থা লেউথওয়েট বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল গত কালই। গোয়েন্দা মহলে ‘শ্বেতাঙ্গ বিধবা’ বলে পরিচিত সামান্থার নাম এর আগেও উঠে এসেছিল ২০০৫ সালে লন্ডনের টিউব রেলে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের সময়। তার পরে আরও বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী হামলায় একাধিক বার জড়িয়েছে তাঁর নাম। গত কয়েক বছর ধরেই ব্রিটিশ পুলিশের ‘হিটলিস্ট’-এ আছে সে। কিন্তু চার দিনের গুলির লড়াইয়ে সে নিহত কি না সে সম্পর্কে কিছু জানায়নি পুলিশ।
‘ন্যাশনাল ডিজাস্টার অপারেশন সেন্টার’-এর তরফে আজ দুপুরেই টুইট করা হয়, “সব পণবন্দিকে উদ্ধার করা গিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কেউ আটকে রয়েছেন কি না নিশ্চিত হতে কেনীয় নিরাপত্তাবাহিনী এখনও চিরুনি-তল্লাশি চালাচ্ছে ওয়েস্টগেট শপিং মলে।”
এ সমস্ত আশ্বাসজনক টুইটের মধ্যেই এ দিন ফের বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ওয়েস্টগেট। পুলিশ জানায়, “সন্ত্রাসবাদীদের রেখে যাওয়া সমস্ত বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করতে গিয়েই ঘটেছে বিস্ফোরণ।”
ভিতরে দিনভর চলেছে সেনা-জঙ্গি মুখোমুখি লড়াই। বাইরে উৎকণ্ঠায় ৬৩টি পরিবার তখনও জানেন না, প্রিয় জনেরা ওই বিশাল পাঁচ তলা শপিং মলের কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে গুলি থেকে বাঁচতে পেরেছেন, না কি পণবন্দি হয়েছেন তা জঙ্গিদের হাতে।
শনিবার বিকেলে ওয়েস্টগেট মলে হামলার কিছু পরেই ঘটনার দায় স্বীকার করে তারা জানিয়েছিল, একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়া বাকিদের হত্যা করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। এক প্রত্যক্ষদর্শী সে দিনের জঙ্গি হানার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, “সব কিছু যেন হিসেব কষে এসেছিল ওরা। একটা করে দোকানে ঢুকছিল, কয়েকটা কথা বলছিল, তার পরেই গুলির শব্দ, চিৎকারের শব্দ। তার পর দোকান থেকে বেরিয়েই আর একটা দোকানে। এ ভাবেই সারা মলে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল ওরা।”
মঙ্গলবার জেনিভায় সোমালিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবদি ফারা শিরদন জানিয়েছেন, জঙ্গি হানা মোকাবিলায় কেনীয় প্রশাসনের সঙ্গেই আছেন তিনি।
|