জিতল শুধু তৃণমূল
ছর চারেক আগে বর্ধমান শহরে একটি স্কুলভোটে হার দিয়ে ‘অপরাজেয়’ বামেদের পতনের সূচনা হয়েছিল। পুরভোটের ফলে বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল।
সেই সঙ্গে আপাতত অবসান হল ৩২ বছরের বাম শাসনের। স্বাধীনতার পর থেকেই যে শহর একটানা কংগ্রেসের দখলে ছিল, ১৯৭৭ সালে রাজ্যে ক্ষমতাদখলের পরে সেখানে পুরবোর্ড ভেঙে দেয় বামফ্রন্ট। ১৯৮১ সালের পুরভোটে তারাই জিতে আসে। এর পরে আর হারেনি। বিধানসভা নির্বাচনে নিরুপম সেনের পরাজয়ে যে পরিবর্তনের ধুয়ো উঠেছিল, তা-ও সমে এসে মিলে গেল।
২০১১ সালের ১৩ই মে-র সেই দিনটির সঙ্গে কিন্তু ২০১৩-র ২৪ সেপ্টেম্বরের ফারাক আছে। ফারাকটা শুধু ভোটের ব্যবধানের নয়, লড়াইয়ের মানসিকতারও। নিরুপমের ৩৭ হাজার ভোটে পিছিয়ে পড়া যে ধাক্কা দিয়েছিল, সেটাই এ বার বেড়ে ১ লাখ ১০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রীর হারের দিনে যে বিষণ্ণতা গ্রাস করেছিল পার্কার্স রোডে সিপিএমের জেলা কার্যালয়কে, মঙ্গলবার সেই ছবিটা উল্টে গেল। নিরুপম লড়ে হেরেছিলেন। আর ভোটের সকালেই খেলা ছেড়ে দিয়ে ফল ঘোষণার দিনটা হাল্কা মেজাজে কাটালেন সিপিএমের জেলা নেতারা। অন্তত প্রকাশ্যে।
বর্ধমানের প্রাক্তন পুরপ্রধান আইনূল হকের তাঁর জামানত জব্দ হয়েছে, পেয়েছেন মাত্র ৫১৪ ভোট। তাঁকে হাসতে-হাসতেই বেরোতে দেখা গেল সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারের ঘর থেকে। অমলবাবু নিজেও কথা বলতে বলতে হেসে ফেলছেন। জেলা কমিটির সদস্য আব্দুল মালেক রসিকতা করছেন থেকে-থেকে। জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য, প্রাক্তন সভাধিপতি উদয় সরকারের মুখেও হাসির আভা।
এ কি হিসেব মিলে যাওয়ার স্বস্তি? যে হিসেব কষে ক’দিন আগে থেকেই বাম নেতারা সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলছিলেন? এবং ভোট শুরু হওয়ার ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে প্রার্থী প্রত্যাহার করে নেন? অমলবাবু বলে ওঠেন, “না, না, কে বলল আমরা স্বস্তিতে? বলতে পারেন, সকলেই হাসিমুখে রয়েছেন। হেরেও আমাদের কমরেডদের দেহভাষায় জয়ই ফুটে বেরোচ্ছে।” বলতে-বলতেই বিকট শব্দে পটকা ফাটে খোদ জেলা অফিসের দরজায়। তৃণমূলের বর্ধমান জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথের কটাক্ষ, “২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের মৃত্যু হয়েছিল। এবারের পুরভোটে মানুষ সিপিএমের শবদেহের অন্ত্যেষ্টি করে ছাড়ল।”
তবে ‘হিসেব’ যে মিলেছে তা জেলা নেতাদের কথাতেই পরিষ্কার। অমলবাবুর ব্যাখ্যা, “রিগিং শুরু হতেই আমরা বামফ্রন্টের সব দলের সঙ্গে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিই, নির্বাচন বয়কট করব। আমাদের এই সিদ্ধান্ত যে ১১০ ভাগ সঠিক ছিল, তা ০-৩৫ ফলেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছে।” অর্থাৎ, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্য তথা কেন্দ্রীয় স্তরে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তাতে অমলবাবুদের জোর জুগিয়েছে এই বিপর্যয়। পাঁচ-দশটা আসন পেয়ে গেলেই হয়তো সরে দাঁড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্নটা আরও বড় হয়ে দাঁড়াত। অমলবাবুর দাবি, “যদি আমরা চোখের সামনে রিগিং দেখেও নীরবে সব সহ্য করতাম, তা হলে আজকের এই ফলে দলের কমরেডদের আত্মবিশ্বাস চুরচুর হয়ে যেত।
তাঁরা তখন আমাদের বলতেন, কেন আপনারা নীরবে সহ্য করলেন সব কিছু? এই যেমন পঞ্চায়েতে এলাকার কমরেডরা বলছেন, যখন ওরা বুথের পরে বুথে ফাঁকা করে রিগিং করল, আপনারা চুপ করে সহ্য করলেন কেন?” প্রাক্তন পুরপ্রধানের দাবি, “তৃণমূল নেতারা বলেছিলেন, অফসাইডে গোল করেও জিতবেন। জিতেছেন।” অমলবাবু ভোটের দিনই দাবি করেছিলেন, বর্ধমানের ৮০ ভাগ মানুষ তাঁদের প্রার্থী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন। তাঁর কথায়, “আমরা লোক জড়ো করে প্রতিরোধ করতে পারতাম। কিন্তু তাতে অশান্তি ছড়াত। তা চাইনি।”
ভোটের হিসেব কিন্তু বলছে, প্রায় ২ লক্ষ ২৫ হাজার ভোটারের মধ্যে ৮২ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১ লক্ষ ৮৩ হাজার ভোট পড়েছে। তার ৭৭ শতাংশই গিয়েছে তৃণমূলের অনুকূলে। বামেদের দাবি, এর বেশির ভাগটাই রিগিং। যা শহরের বাসিন্দাদের অনেকেরই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। কেননা বুথে তেমন হিংসা তাঁরা দেখেননি। সকাল-সকাল যে সমস্ত বুথে রিগিংয়ের অভিযোগ তোলা হয়েছিল, প্রার্থী প্রত্যাহার সত্ত্বেও তার বেশ কয়েকটিতে ভাল ভোট পেয়েছেন বাম প্রার্থীরা। যেমন ১১ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী শিবশঙ্কর সাহা, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের নাসরুবা বেগম শেখ, ৩১ নম্বরে সিপিএমের পায়েল দত্ত ২০ শতাংশ করে, ২৬ নম্বরে সিপিএমের মহম্মদ জোবের আলি ২২ শতাংশ, ২ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএমের শিখা সাহা ও ৩৫ নম্বরে সিপিএমের অরিন্দম মৌলিক ২৪ শতাংশ, ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে সিপিআই প্রার্থী অমিত হাজরা চৌধুরী ৩১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। আরও অনেকেরই প্রাপ্ত ভোট এর আশপাশে রয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ভোট, ৯১ শতাংশ পেয়েছেন ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে দাঁড়ানো বর্ধমান শহর যুব তৃণমূল সভাপতি তথা প্রাক্তন কাউন্সিলর খোকন দাস। গত বার যে ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে তিনি প্রচুর কাজ করেছিলেন, সেই ২৪ নম্বরও ৯১ শতাংশ ভোট পেয়েছে তৃণমূল। এর আগে সাত বার জিতে আসা সমীর রায় ৩২ নম্বরে পেয়েছেন ৮৮ শতাংশ ভোট। কিন্তু অনেক ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও ৩০ নম্বরে স্বরূপ দত্ত মোটে ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। তাঁর মতো ৭০ শতাংশের নীচে ভোট পেয়েছেন আরও বেশ কয়েক জন তৃণমূল প্রার্থী। রিগিংয়ের ফলে যদি তৃণমূলের ভোট বেড়েও থাকে, তা গোটা ফলাফল নির্ধারণ করে দিয়েছে, শহরের অনেক বাম নেতা-কর্মীও তা মানতে পারছেন না।
আইনূল হককে হারিয়ে অরূপ দাসের মন্তব্য, “উনি ওয়ার্ডে ‘বহিরাগত’। তাই মানুষ আমায় দু’হাতে ভোট দিয়েছে।” অষ্টম বার জিতে সমীর রায় হাসতে-হাসতে বলেন, “এই শহরে সিপিএমের আর ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় নেই।” খোকন দাসের মতে, “বিধানসভার ভোটেই বর্ধমানের মানুষ বামবিরোধী ভোট দিয়েছিলেন। এ বার আরও দায়িত্ব দিলেন।” স্বরূপবাবুর উপলব্ধি, “আমাদের ৩৫টি ওয়ার্ডে এক জনই জিতেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।”
পার্কার্স রোডের বাড়িটি থেকে বেরনোর আগে সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য কাছে ডেকে জানতে চান, “আচ্ছা, ভোটের দিন কোনও বুথে কাউকে ইভিএম বের করে বোতাম টিপতে, জোড়াফুলে ছাপ দিতে জোর করতে দেখেছিলেন?” স্বীকার করতে হয়, ‘দেখিনি।’ “হুম...” বলে চিন্তায় ডুবে যান প্রবীণ বাম নেতা।

ভোটের ফল

যদি রিগিং দেখেও সরে না আসতাম,
এই ফলে দলের কর্মীদের আত্মবিশ্বাস
চুরমার হয়ে যেত।
অমল হালদার

২০১১ সালের বিধানসভা নিবার্চনেই সিপিএমের
মৃত্যু হয়েছিল। এ বারের পুরভোটে মানুষ
ওঁদের অন্ত্যেষ্টি করে ছাড়লেন।
স্বপন দেবনাথ

• ওয়ার্ড ১ জয়ী প্রার্থী শুক্তি শুভ্রা সাহানা (৮৪%)
• ওয়ার্ড ২ জয়ী প্রার্থী সোমা মালিক (৭৬%)
• ওয়ার্ড ৩ জয়ী প্রার্থী মহম্মদ সেলিম খান (৮৩%)
•ওয়ার্ড ৪ জয়ী প্রার্থী মহম্মদ আলি শেখ (৮৪%)
• ওয়ার্ড ৫ জয়ী প্রার্থী শেফালি বেগম (৮২%),
• ওয়ার্ড ৬ জয়ী প্রার্থী মহম্মদ সেলিম শাহেদ (৭৯%)
• ওয়ার্ড ৭ জয়ী প্রার্থী ডঃ জয়ন্ত কুমার দত্ত (৭৪%)
• ওয়ার্ড ৮ জয়ী প্রার্থী সুদীপ্ত ভট্টাচার্য (৬৪%),
• ওয়ার্ড ৯ জয়ী প্রার্থী শিখা দত্ত (৭৮%)
• ওয়ার্ড ১০ জয়ী প্রার্থী পরেশচন্দ্র সরকার (৭৩%)
• ওয়ার্ড ১১ জয়ী প্রার্থী শক্তি রঞ্জন মণ্ডল (৮০%)
• ওয়ার্ড ১২ জয়ী প্রার্থী পম্পা পাল (৭৪%)
• ওয়ার্ড ১৩ জয়ী প্রার্থী ডঃ বিভূতোষ মণ্ডল (৭০%)
• ওয়ার্ড ১৪ জয়ী প্রার্থী গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য (৭০%)
• ওয়ার্ড ১৫ জয়ী প্রার্থী ডঃ শঙ্খশুভ্র ঘোষ (৭৬%)
• ওয়ার্ড ১৬ জয়ী প্রার্থী আলপনা হালদার (৭৬%)
• ওয়ার্ড ১৭ জয়ী প্রার্থী রূপালি কালবর্তিয়া (৭৫%)
• ওয়ার্ড ১৮ জয়ী প্রার্থী প্রদীপ রহমান (৮৪%)
• ওয়ার্ড ১৯ জয়ী প্রার্থী শাহাবুদ্দিন খান (৭১%)
• ওয়ার্ড ২০ জয়ী প্রার্থী মমতা রায় (৬৮%)
• ওয়ার্ড ২১ জয়ী প্রার্থী শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ (৬২%)
• ওয়ার্ড ২২ জয়ী প্রার্থী সমীর মুন্ডা (৭১%)
• ওয়ার্ড ২৩ জয়ী প্রার্থী খোকন দাস (৯১%)
• ওয়ার্ড ২৪ জয়ী প্রার্থী সুমল মিস্ত্রি (৯১%)
• ওয়ার্ড ২৫ জয়ী প্রার্থী শঙ্করী ঘোষ (৮১%)
• ওয়ার্ড ২৬ জয়ী প্রার্থী মহম্মদ শহিদুল্লাহ খোন্দকর (৭২%)
• ওয়ার্ড ২৭ জয়ী প্রার্থী শেখ বসির আহমেদ (বাদশা) (৮০%)
• ওয়ার্ড ২৮ জয়ী প্রার্থী রেখা তেওয়ারি (৬৫%)
• ওয়ার্ড ২৯ জয়ী প্রার্থী সুশান্ত প্রামাণিক (৮২%)
• ওয়ার্ড ৩০ জয়ী প্রার্থী ডঃ স্বরূপ দত্ত (৬৬%)
• ওয়ার্ড ৩১ জয়ী প্রার্থী রত্না রায় (৭৪%)
• ওয়ার্ড ৩২ জয়ী প্রার্থী সমীর কুমার রায় (৮৮%)
• ওয়ার্ড ৩৩ জয়ী প্রার্থী অরূপ কুমার দাস (৮৪%)
• ওয়ার্ড ৩৪ জয়ী প্রার্থী উমা সেন (৭৬%)
• ওয়ার্ড ৩৫ জয়ী প্রার্থী সনৎ কুমার বক্সী (৭৪%)।

(বন্ধনীতে জয়ী প্রার্থীর প্রাপ্ত শতাংশ ভোট)

ছবি: উদিত সিংহ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.