ফি বর্ষায় পাড় ভাঙছে তারাফেনি নদী। ভাঙনের গ্রাসে চলে যাচ্ছে নদী তীরের ঘরবাড়ি, ভিটেমাটি। অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন বাসিন্দারা। পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমানা লাগোয়া বাঁকুড়ার বারিকুল থানার গোজদা গ্রাম এ ভাবেই ধীরে ধীরে জনশূন্য হতে চলেছে। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, গত দশ বছর ধরে এমনটাই চলছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ মেলেনি। ভাঙন ঠেকাতে উদ্যোগীও হয়নি প্রশাসন।
তারাফেনি নদীর পূর্ব তীরে বারিকুল থানার মেলেড়া পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ছোট্ট গ্রাম গোজদা। এই গ্রামে প্রায় ২০০টি পরিবারের বসবাস। অধিকাংশই প্রান্তিক চাষি ও দিনমজুর। তাঁদের মধ্যে তারাফেনির নদীর তীরে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ৫০টি পরিবার বসবাস করতেন। প্রতি বছর বর্ষায় টইটম্বুর হয়ে তারাফেনি দু’কূল ভাসিয়ে দিচ্ছে। সেই জলের তোড়ে গোজদা গ্রাম লাগোয়া পাড় অহরহ ভাঙছে। নদী গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে বহু বাড়ি। অনেকে তাই প্রাণভয়ে বসতভিটে ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। |
বাসিন্দাদের দাবি, গত ১০ বছরে তারাফেনি নদীর তীরে বসবাস করা প্রায় ২৫টি পরিবার আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছেন। নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে কম বেশি ২০টি বাড়ি। আরও কয়েকটি বাড়ির ধার ঘেঁসে এগিয়ে এসেছে তারাফেনি। তাই কেউ সপরিবারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন। কেউ আবার গ্রামের ভিতরের দিকে বাড়ি করে বসবাস করছেন। আর প্রশাসনের কাছে এমন খবর না থাকায় মেলেনি ক্ষতিপূরণ।
সম্প্রতি গোজদা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, তারাফেনি নদীর পাড়ের একাংশ ভেঙেছে। নদীতে নামার জন্য পাকা সিঁড়ির একাংশ ধসে পড়েছে। নদীর পাড়ে কয়েকটি বাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেও যে কোনও মূর্হুতে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসী বাহাদুর গিরি জানালেন, প্রতি বছর বর্ষায় তারাফেনি নদী পাড় ভাঙতে ভাঙতে গ্রামের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। বছর দশেক ধরে ভাঙন চলছে। বাসিন্দারা জানালেন, গ্রামের বটকৃষ্ণ ঘোষ, নিরঞ্জন বিশুই, কৃষ্ণ গড়াই, খোকন বিশুই, বালক গড়াই, পল্টু গিরি, বিভূতি গড়াই, গোকুল বিশুই-সহ বহু লোকের বাড়ি চলে গিয়েছে তারাফেনির গ্রাসে। তাঁদের অনেকে তাই প্রাণ বাঁচাতে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছেন।
ভাঙনের জেরে ভিটে ছেড়ে অন্যত্র ঘর বেঁধেছেন স্থানীয় রেশন ডিলার স্বপন ঘোষ। তিনি বলেন, “নদীর পাড়ে আমার বাড়ি ছিল। বছর পাঁচেক আগে বর্ষায় নদীর পাড় ধসে বাড়ির একাংশ বসে যায়। প্রাণ বাঁচাতে তাই ওখান থেকে পালিয়ে গ্রামেরই অন্যত্র নতুন করে বাড়ি তৈরি করে রয়েছে। তবে সরকারের তরফে কোনও ক্ষতিপূরণ পাইনি।” গ্রামবাসী লব মণ্ডল, ফণী গড়াই, সন্তোষ গিরিদের ক্ষোভ, “আমাদের আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। বাড়ি ভেঙে পড়ায় সমস্যায় পড়েছিলাম। ক্ষতিপূরণ দেওয়া তো দূরের কথা, প্রশাসন থেকে খোঁজও করতে আসেনি।”
নদী ভাঙন রোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? এ নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা যথারীতি বাদানুবাদে জড়িয়েছেন। মেলেড়া পঞ্চায়েতের প্রধান তথা রাইপুর ব্লক যুব তৃণমূল সভাপতি রাজকুমার সিংহ বলেন, “ওই গ্রামে নদীর পাড় ভাঙার কথা জানি। বেশ কয়েকটি পরিবার ভাঙনের জন্য অন্যত্র সরে গিয়েছেন। বামফ্রন্ট সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন থাকায় সমস্যা আরও বেড়ে গিয়েছে। গ্রামের মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। নদী ভাঙন রোধে প্রশাসনের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাব।” রাইপুরের দীর্ঘ সময়ের সিপিএম বিধায়ক উপেন কিস্কু-র পাল্টা দাবি, “আমরা রাজ্যের ক্ষমতায় থাকার সময় নদী ভাঙন রোধে কিছু কাজ করেছিলাম। গত বছর বন্যার তোড়ে ভাঙন বাড়লেও বর্তমান সরকার তা ঠেকাতে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি।”
খাতড়ার মহকুমাশাসক শুভেন্দু বসু বলেন, “বিষয়টি আমাকে জানানো হয়নি। স্থানীয় বিডিও-কে খোঁজ নিয়ে দেখতে বলব। তেমন হলে সেচ দফতরকে বিষয়টি জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলব।” কংসাবতী সেচ দফতরের সুপারিন্টেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার ১ বিশ্বনাথ কুমার বলেন, “আগে কী হয়েছে জানি না। তবে এ বছর তারাফেনি নদীতে বড় কোনও ভাঙনের খবর শুনিনি। তবে খোঁজ নেহ।” সেচ দফতরের বাঁকুড়া ডিভিশনের এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার স্মরজিৎ সরকার অবশ্য সমস্যাটির কথা জানেন। তিনি বলেন, “ওই এলাকায় নদী ভাঙন রোধের জন্য একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দু’বছর আগে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের কাছে ভাঙন রোধের একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু অনুমোদন মেলেনি। তাই কাজ করা যায়নি।” তিনি এখনও ওই প্রকল্পের অনুমোদনের আশায় রয়েছেন। পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী সুকুমার হাঁসদা জানান, প্রস্তাবটি জমা পড়ে রয়েছে বলে তিনি জানেন না। তাঁর আশ্বাস, “ খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।” তারাফেনির কোল যাঁদের ঘরের কাছে এগিয়ে এসেছে, আশায় রয়েছেন তাঁরাও। |