র্যাগিং একটি অপরাধ, এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কথাটি প্রথমেই পরিষ্কার করিয়া লওয়া ভাল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা দেখিয়া আশঙ্কা হয় যে এই গোড়ার কথাটি ছাত্রছাত্রীরা ভুলিতে বসিয়াছে। অপরাধী মানসিকতার সমস্যা ইহাই। বারংবার একই ধরনের অন্যায় ঘটিতে ঘটিতে সেই অন্যায়কার্যের একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হইয়া যায়, মনে হয়, এমন তো হয়ই, নূতন কী। অন্যায়কারীকে শাস্তিদান তখন বাড়াবাড়ি ঠেকে, কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে জাঁকাইয়া প্রতিষ্ঠা করিতে ফিরিয়া ভাবিতে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে, বিশেষত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে র্যাগিং বিষয়ে এমন এক অবিচল গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হইয়াছে। সতীর্থদের র্যাগিং-এর কারণে একের পর এক চরম দুর্ঘটনা ঘটিয়া গেলেও কোনও বোধোদয়ের লক্ষণ এখনও দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। আরও এক বার স্পষ্ট করিয়া বলা দরকার যে, র্যাগিং বিষয়টি স্পষ্টতই অপরাধপ্রবণ মানসিকতার প্রমাণ, অন্য কোনও যুক্তি-তথ্য-দৃষ্টান্ত-প্রথা এ ক্ষেত্রে গ্রাহ্য নয়। কাহারও উপর শারীরিক-মানসিক কোনও অত্যাচার করিবার অধিকারই কাহারও নাই, সে তাহারা নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাল’ ছাত্রছাত্রী হইলেও নয়। অপরাধ প্রমাণিত হইলে যাদবপুরের ছাত্র এবং মার্কামারা অপরাধীর মধ্যে এক বিন্দু পার্থক্য করা চলে না। এই সহজ গোড়ার কথাটি ঘেরাও-প্রেমী পড়ুয়ারা মনে রাখিতেছেন না।
পরের প্রশ্ন, কোন ব্যবহারটি র্যাগিং-এর পর্যায়ে পড়ে আর কোনটি পড়ে না। ঘটনার তদন্তের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত হইয়াছে সে বিষয়ে প্রশ্ন বা আপত্তি থাকিলে অন্য ভাবেও তাহা জানানো সম্ভব। তবে কিনা, ঘেরাওকারীদের চোখে তাঁহাদের বহিষ্কৃত ‘বন্ধু’-দের অপরাধ যত সামান্যই হউক না কেন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তই মান্য, বিশেষত যখন এই বিষয়টির জন্য আলাদা কমিটির হাতে ভার দেওয়া হইয়াছে। নব্য-তরুণ বিদ্রোহীরা নিশ্চয়ই গণতন্ত্র-বোধে উদ্দীপ্ত হইয়া ঘেরাও ও অনশন কর্মসূচিতে দলে দলে যোগ দিতেছেন, কিন্তু ভাবিলে তাঁহারাও উপলব্ধি করিবেন যে, কমিটির নির্দেশ অমান্য করাই গণতন্ত্রের একমাত্র অর্থ নয়, একটি বিশেষ লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটিকে নিজের মতো সিদ্ধান্ত লইতে দেওয়া ও সেই সিদ্ধান্ত মান্য করাও গণতন্ত্রের আর এক অর্থ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সহ-উপাচার্য নিযুক্ত হইয়াছেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই, প্রতিষ্ঠানের ভালমন্দ তাঁহাদেরই দায়িত্ব। সে দায়িত্ব পালন করিতে না দিয়া তাঁহাদের দুই দিন বন্দি রাখিয়া সংবাদ-শিরোনাম হইবার গৌরব লাভ করা যায়, শুভ রাজনীতিবোধের পরিচয় দেওয়া যায় না। এ রাজ্যে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্যের অবধি নাই। দুর্ভাগ্য যে, সেই নৈরাজ্যে ছাত্রদের নিজেদের নেতি-ভূমিকাও বিরাট। কখনও ‘বহিরাগত’ কখনও রাজনৈতিক দলের উপর দোষ চাপাইয়া যতই তাহাদের ‘সুকুমারমতি’ হিসাবে দেখানো হউক, নিজেদের দায়িত্ব বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের আর একটু অবহিত হওয়া প্রয়োজন। কোনটি অপরাধ কোনটি নহে, তাহার সদ্বিবেচনা প্রয়োজন। সস্তা রাজনীতির ভুল রাস্তায় সহজে প্রলুব্ধ হইয়া তাঁহারা নিজেদের ক্ষতির সহিত বৃহত্তর সমাজেরও ক্ষতি করিতেছেন। এই ‘সচেতন’ ছাত্রছাত্রীরা র্যাগিং-এর অভিযোগে শাস্তিপ্রাপ্ত-দের বিচারের জন্য দুই দিন বিশ্ববিদ্যালয় অচল না করিয়া কেন র্যাগিং-এ অত্যাচারিত সতীর্থদের সুবিচারের জন্য ঘেরাও আন্দোলন করেন না? কেননা, নৈরাজ্যই তাঁহাদের অভীষ্ট, সুবিচার নহে। |