রঘুরাম রাজন যে দুব্বুরি সুব্বারাও নহেন, এই কথাটি ভারতের জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে ধ্বনিত হইতেছে। শুক্রবার রাজন প্রমাণ করিলেন, বাজার তাঁহাকে যে চোখেই দেখুক, তাঁহার আত্মপ্রত্যয়ী উপস্থিতি কাহারও মনোজগতে যত তুমুল ঢেউই তুলুক, নিজের দায়িত্বের অভিজ্ঞানটি ভুলিয়া সেই উচ্ছ্বাসের স্রোতে ভাসিয়া যাইতে তিনি নারাজ। সুব্বারাওয়ের পাখির চোখ হইতে রাজনও দৃষ্টি সরাইতে অসম্মত। শুক্রবার তিনি জানাইয়াছেন, ব্যাঙ্কের প্রথম কর্তব্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। তাঁহার বার্তায় বাজার স্বাভাবিক ভাবেই চমকাইয়াছে। যাঁহার নিকট বৃদ্ধির হারের মসিহা হইয়া উঠিবার প্রত্যাশা ছিল, তাঁহার মুখে এ কী কথা! তবে, প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিলে বাজার বুঝিবে, রাজন জানেন, পাণিনি শিরোধার্য। ব্যাকরণ ভুলিতে নাই।
ব্যাঙ্কের প্রধান রূপে তাঁহার কর্তব্য রাজন জানেন বৃদ্ধির হারের হাতছানিতে সর্বস্ব বাজি ধরা তাঁহার কাজ নহে। আর্থিক বৃদ্ধি যে জরুরি, এবং তাহা নিশ্চিত করিতে যে ব্যাঙ্কেরও দায়িত্ব আছে, তাহা অনস্বীকার্য। তিনি ক্যাশ রিজার্ভ রেশিয়ো অপরিবর্তিত রাখিয়াছেন; বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি অতি-স্বল্পমেয়াদে যে ঋণ নেয়, তাহার সুদের হার কমাইয়াছেন। বিনিয়োগের পক্ষে, সুতরাং বৃদ্ধির পক্ষে, তাহা ইতিবাচক। কিন্তু, আর্থিক বৃদ্ধিই যে একমাত্র বা প্রধানতম লক্ষ্য নহে, তাহা বুঝাইতেই রাজন রেপো রেট বাড়াইয়াছেন। সেই বৃদ্ধি সামান্যই, কিন্তু তাহা বাজারের প্রত্যাশার বিপ্রতীপ। বিগত দুই বত্সরে সুব্বারাও-ও এই কাজটি করেন নাই। বাজার অনুমান করিয়াছিল, রাজনও করিবেন না। কিন্তু রাজন দীর্ঘ দিন যাবত্ বলিয়া আসিয়াছেন যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একটি কাজেই মনোনিবেশ করা উচিত, এবং সেই কাজটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। তিনি নিজের বিশ্বাস হইতে সরেন নাই। বাজার হয়তো তাঁহাকে ভুল বুঝিয়াছিল।
রাজন যে শিথিল আর্থিক নীতির পাল উড়াইয়া দিবেন, এবং তাহাতে নাম লিখিবেন ‘বৃদ্ধি’, বাজারের এমত প্রত্যাশার জন্ম বুধবারের ওয়াশিংটন ডিসি-তে। সে দিন ফেডারাল রিজার্ভ জানাইয়াছিল, মে মাসে ঘোষিত নীতি হইতে তাহারা আপাতত সরিয়া আসিতেছে, অর্থাত্ এখনই মার্কিন বাজারে বন্ড কেনা বন্ধ হইতেছে না। ভারত-সহ বহু উন্নয়নশীল দেশের বাজার হইতে বিদেশি লগ্নির যে বহির্মুখী যাত্রা মে মাস হইতে ক্রমে গতিশীল হইতেছিল, এই ঘোষণায় তাহা থামিয়াছে। অর্থাত্, চাপ খানিক হইলেও কমিল। বাজারের প্রত্যাশা ছিল, রাজন এই সুবিধাটি কাজে লাগাইয়া আর্থিক নীতি শিথিলতর করিবেন।
ফেড-এর ঘোষণাটি যে ‘সাময়িক’, বাজার সম্ভবত তাহা ভুলিয়া গিয়াছিল। রাজন ভোলেন নাই। তিনি বলিয়াছেন, ‘স্থগিত রাখা’র অর্থ ‘স্থগিত রাখা’ আজকের পরিবর্তে আগামী কাল ফেড এই আর্থিক উত্সাহ বন্ধ করিয়া দিবে। যতটুকু সময় হাতে পাওয়া গেল, তাহাকে কাজে লাগাইয়া ঘর গুছাইয়া লওয়াই কর্তব্য। রাজন ভারতের ব্যালান্স শিট-কে ‘বুলেট প্রুফ’ করিয়া তুলিবার কথা বলিয়াছেন। অর্থাত্, টাকার দামকে স্থিতিশীল করা, বাণিজ্য খাতে ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আনা, মূল্যস্ফীতিতে লাগাম পরানো। আপাতত অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা জরুরি। ইউরোপীয় বাজার ক্রমে স্বাস্থ্যে ফিরিতেছে, সিরিয়ার সংকটও সাময়িক ভাবে কাটায় তেলের দাম স্থিতিশীল হইয়াছে। রাজন জানাইয়াছেন, দেশের ডলার-ভাণ্ডারে হাত না দিয়াই বাণিজ্য খাতে ঘাটতির চাপ সামলানো সম্ভব হইবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যাহা কর্তব্য, রাজন করিয়াছেন। বাকি কাজ সরকারের। ভারতে বিনিয়োগের ধারা শুকাইয়া যাইবার একটি কারণ যদি চড়া সুদের হার হয়, অন্য কারণগুলির সব কয়টির শিকড়ই দিল্লিতে। সরকার সেই দিকে না তাকাইলে বুলেট-প্রুফ অর্থনীতি স্বপ্নমাত্র। |