মেয়েকে জাপটে ধরে গাড়ির নীচে শুয়ে পড়েছিলেন তিনি। চার্লস কারানি। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, কর্মসূত্রে নাইরোবিতে থাকেন।
গাড়ির তলায় একফালি জায়গাটায় আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, শ্বাসটাও যদি একটু আস্তে ফেলা যায়। শরীরটাকে কুঁকড়ে গাড়ির তলায় কোনও মতে আশ্রয় নিয়েছেন আরও দুই মহিলা। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন বুকের মধ্যে মাত্রাছাড়া গতিতে হৃৎস্পন্দন। আর চোখের সামনে যা দেখছেন, হলিউডি ছবি বললেও কম বলা হবে।
জনা চল্লিশ লোক সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে। গাড়ির তলা দিয়ে কোনও মতে দেখতে পেলেন, সাদা টুপি পড়া কয়েক জন বন্দুকবাজ এগিয়ে গেল তাঁদের দিকে। একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের নাম করে জানতে চাইল, সেই সম্প্রদায়ের কে কে আছেন? যাঁরা এগিয়ে এলেন, তাঁদের জন্য দ্বিতীয় প্রশ্ন ধর্মগুরুর মায়ের নাম কী? মুহূর্তের অপেক্ষা। যাঁরা ভুল বললেন, গুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল তাঁদের মাথা। |
যেন যুদ্ধক্ষেত্র। নাইরোবির শপিং মলে কেনিয়ার সেনা। ছবি: এএফপি। |
চার পাশে চাপচাপ রক্ত, কান্নার আওয়াজ, আর্তনাদ। অতগুলো লোককে মেরেও ক্ষান্ত হল না জঙ্গিরা। হাওয়ায় গুলি ছুড়তে শুরু করল। সঙ্গে হিংস্র জয়োল্লাস। চার্লসদের সঙ্গে থাকা দুই মহিলার পায়ে গুলি লাগল। যন্ত্রণা যতই হোক, প্রকাশ করার উপায় নেই। চার্লস আজ বলছিলেন, “এক জন ভারতীয়কে দেখলাম। মুখ লক্ষ্য করে গুলি চালাল জঙ্গিরা। গায়ে লাগেনি বোধহয়। হয়তো বেঁচে গিয়েছেন। তবে বাকিরা কেউ বেঁচে নেই, নিশ্চিত।”
সে দিক থেকে নজর ঘুরল মেয়ের আর্তনাদে। “পাপা, ওখানে গ্রেনেড।” ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন চার্লস। গ্রেনেডটা ফাটেনি। পা দিয়ে ওটাকে সরিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটাতে ওয়েস্টগেটে গিয়েছিলেন সারা হেড। পার্কিং লটে ছিলেন। হঠাৎই গুলির আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে কান্না আর আর্তনাদ। সবাই ছুটলেন সিঁড়ির দিকে। মাথায় ঘুরছিল একটাই চিন্তা, উপরে উঠতে হবে। তা হলেই হয়তো বাঁচবে প্রাণটা। কিন্তু কয়েক ধাপ উঠতেই জোরে বন্দুকের আওয়াজ। “শব্দটা এ বার যেন খুব কাছে,” মনে হতেই আর এগোনোর সাহস দেখাতে পারলেন না তাঁরা। খুঁজতে লাগলেন লুকনোর জায়গা। সঙ্গীদের সকলকে চেনেন না। চেনার দরকারও নেই। তখন সকলেরই লক্ষ্য নিরাপদ আশ্রয়।
সারা বলছিলেন, বন্দুকের টানা গর্জনের পর হঠাৎই যেন খুব শান্ত হয়ে গেল চারপাশ। মিনিট পনেরো আর আওয়াজ নেই। তখনও তাঁরা বুঝতে পারছেন না, এগোবেন না পিছোবেন। এর মধ্যেই বরকে ফোন করেন সারা। এ দিক ও দিক নজর যেতে দেখেন, এয়ার কন্ডিশনের সুড়ঙ্গের মধ্যে লুকোচ্ছে বাচ্চা একটি মেয়ে। কেউ বা ম্যানিকুইনের আড়ালে।
সিঁড়িতে ও ভাবে দেড় ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। কে, কেন, কী করছে, ধোঁয়াশা ছিল পুরোটাই। হঠাৎই সুপার মার্কেটের দরজাটা খুলে গেল। লোকজন হুড়মুড়িয়ে ছুটে গেল সে দিকে। সারা তখন ধন্দে, যাবেন কি? শেষমেশ পা চালালেন তিনিও। যেতে যেতেই দেখলেন রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। শপিং মলের বাইরে পা ফেলতেই দুদ্দার করে ছুটলেন সবাই। মলের বাইরে গিয়েও অনেকে থামতে পারলেন না আতঙ্কে।
সারার মতোই অভিজ্ঞতা কাইগোয়া ওকোয়ের-এর। গুলির প্রথম আওয়াজটা শুনে ভেবেছিলেন, টেবিল ভেঙেছে কোথাও। কিন্তু তার পর লাগাতার কান-ফাটানো আওয়াজ। হঠাৎই দেখলেন, এক দল লোক ছুটছে। তাদের সঙ্গ নিয়েও বের হতে পারলেন না সাহসের অভাবে। কিন্তু একটা কোণা খুঁজে পা রাখতেই তাঁদের দিকে ছুটে এল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। আবার দৌড়। পুরুষ হয়েও মহিলাদের বাথরুমে ঢুকে পড়লেন। সেখানে তখন জনা কুড়ি লোক আশ্রয় নিয়েছেন। বসে ঠক ঠক করে কেঁপেছেন। কত ক্ষণ? “বলতে পারব না। আধ ঘণ্টাও হতে পারে। আবার দু’ঘণ্টাও,” বলছিলেন কাইগোয়া। শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছেন তিনি। কারণ, ওই টয়লেটের সামনে কিছু ক্ষণের মধ্যে চলে আসে কেনিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী।
জুলোবিয়া কাসামকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও কিছু ক্ষণ। কফি খেতে এসেছিলেন মলে। ঢুকতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। জেনারেটর চালানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তার বদলে দেখলেন অন্ধকারের মধ্যেই লোকে ছুটছে। আর গুলির শব্দ। জুলোবিয়াও ছুটলেন ওয়েস্টগেটের পিছনে দিকটায়। “উপরের তলায়, নীচে সর্বত্র গুলির আওয়াজ,” বলছিলেন ওই তরুণী। কোনও মতে লুকনোর জায়গা খুঁজে বের করেছিলেন। বেশ কিছু ক্ষণ পরে এক নিরাপত্তারক্ষী এসে বলল, পথ হয়েছে, পালাও। গুদামের ভিতর দিয়ে নিঃশব্দে পা ফেলে পালালেন জুলোবিয়ারা।
ছুটতে ছুটতে দেখলেন, এখানে ওখানে পড়ে রয়েছে নিথর দেহ। |