প্রার্থনা শেষের ঘণ্টা তখন সবে বেজে উঠেছে। এমন সময় হঠাৎই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল গির্জা প্রাঙ্গণ। একটা নয়। ৩০ সেকেন্ডের ব্যবধানে পর পর দু’-দু’টি আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিমেষের মধ্যে মৃত্যুপুরীর চেহারা নিল ‘অল সেন্ট’ গির্জা চত্বর।
খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সৌকত ইউসুফজাই জানিয়েছেন, রবিবারের এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে সাত শিশু, ও তিরিশ জন মহিলা-সহ ৭৮ জনের। আহতের সংখ্যা প্রায় দেড়শো। বিস্ফোরণের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত গির্জা সংলগ্ন বাড়িগুলিও। ঘটনার দায় স্বীকার করে নিয়েছে তেহরিক-ই-তালিবানের শাখা সংগঠন জানবুল্লা। সংগঠনের মুখপাত্র আহমেদ মারওয়াত জানান, পাকিস্তানের মাটিতে মার্কিন ড্রোন হানা ঠেকাতেই তাদের এই হামলা। তাঁর বক্তব্য, যত দিন আমেরিকা ড্রোন হানা বন্ধ না করছে তত দিন অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর জানবুল্লার জঙ্গি হানা চলতে থাকবে।
পেশোয়ারের কোহাতি গেট এলাকায় অবস্থিত এই ‘অল সেন্ট’ গির্জাটি তৈরি ব্রিটিশ আমলে। বয়স প্রায় ১৩০। গির্জাটিকে কেন্দ্র করেই এলাকায় সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের আস্তানা গড়ে ওঠে বিশ শতকে। রবিবার সকালে গির্জার প্রার্থনাগৃহে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৭০০ জন। প্রার্থনা শেষে দরিদ্রদের মধ্যে বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণের জন্য যখন বেরিয়ে এলেন তাঁরা তখনও বোধহয় কেউই জানতেন না বাইরে ওত পেতে রয়েছে কী ভীষণ বিপদ। |
নাতনির নিথর দেহ কোলে কান্না ঠাকুমার। পেশোয়ারে। ছবি: এপি |
প্রার্থনাকারীদের ভিড়ের মধ্যেই মিশে ছিল দুই আত্মঘাতী জঙ্গি। ধাক্কাধাক্কিতে হঠাৎই ফেটে যায় ছ’কেজি করে বিস্ফোরক ঠাসা জ্যাকেট দু’টি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় পঞ্চাশ জনের। আহতদের লেডি রিডিং হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকেরা জানান, তাঁদের মধ্যে ১৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের প্রধান মাহমুদ জানিয়েছেন, উদ্ধার হয়েছে আত্মঘাতী দুই সন্দেহভাজন জঙ্গির ছিন্নভিন্ন শরীরও।
ঘটনার পর পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেছে পাক সেনা। উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এলাকার দোকানপাট। যে সব হাসপাতালে বিস্ফোরণে আহতদের চিকিৎসা চলছে সে সব এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
রবিবারের এই ঘটনার প্রতিবাদে পথে নেমেছেন খ্রিস্টানরা। লেডি রিডিং হাসপাতাল ও ‘অল সেন্ট’ গির্জা চত্বর ঘিরে রেখে এ দিন দীর্ঘ ক্ষণ বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। পরিজনের মৃতদেহ নিয়ে ব্যস্ত জিটি রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান নিহতদের আত্মীয়েরা। কোহাতি গেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তায় খামতি থাকার অভিযোগে পুলিশকেই দুষেছেন তাঁরা।
রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভার বৈঠকে যোগ দিতে এ দিনই নিউ ইয়র্কে রওনা হয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। ঘটনার নিন্দা করে তিনি জানিয়েছেন, “জঙ্গিদের কোনও ধর্ম হয় না। নিরপরাধদের উপর এ হেন হানা নৃশংস ও অমানবিক মানসিকতারই পরিচয়।” এ দিন ‘অল সেন্ট’ গির্জা চত্বর পরিদর্শন করেছেন আওয়ামি ন্যাশনাল পার্টির নেতা তথা প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী মিয়ান লিফতিখার হুসেন। খ্রিস্টানদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন তিনি। ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিও। তাঁর দাবি, রবিবারের এই ঘটনাই হয়তো চোখ খুলে দেবে জঙ্গি তোষণে বিশ্বাসকারীদের। তিনি জানান, “আমাদের নীতিবোধ, আমাদের জীবনযাত্রা, আমাদের অস্তিস্ব সবই এখন জঙ্গি হানার শিকার। গোটা দেশকে একজোট হয়ে যুঝতে হবে এই সঙ্কট।” তাঁর মত, জঙ্গি সমস্যা সমাধানে শান্তিপূর্ণ আলোচনার যে পথ বেছেছেন প্রধানমন্ত্রী, রবিবারের ঘটনার পর একটা বড়সড় ধাক্কা খেল তা। এ দিকে রবিবারই উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানে বোমা বানাতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে তিন লস্কর-ই-ইসলাম জঙ্গির। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ওই জঙ্গি গোষ্ঠীর মুখপাত্রও।
খ্রিস্টানদের উপর জঙ্গি হানার ঘটনার নিন্দা করে তিন দিন পেশোয়ারবাসীকে কালো পোশাক পরার অনুরোধ জানিয়েছে আর্ন্তজাতিক ধর্ম পরিষদ। এই তিন দিন পেশোয়ারের সব মিশনারি স্কুল ও কলেজ বন্ধ রাখার নির্দেশও দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এর আগে ২০০১ সালে ভাওয়ালপুরে জঙ্গি হানায় মৃত্যু হয়েছিল সতেরো জন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীর। ২০০২ সালে ইসলামাবাদের দূতাবাস সংলগ্ন গির্জায় জঙ্গি হানায় মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ জনের। যাঁদের বেশির ভাগই খ্রিস্টান ছিলেন। ২০০৯ সালে পঞ্জাব প্রদেশের গোজরা শহরে খ্রিস্টান পাড়ার প্রায় চল্লিশটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় সাত জনের। তাই পাকিস্তানের মাটিতে সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের উপর জঙ্গি হানার ঘটনা এই প্রথম না। তবে রবিবারের বীভৎসতা ছাপিয়ে গিয়েছে অতীতের সব ইতিহাসই।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নাজির খান, পেশায় স্কুল শিক্ষক। সাংবাদিকদের জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতা। গলায় তখনও আতঙ্কের ছায়া স্পষ্ট। কাঁপা কাঁপা স্বরে নাজির বলে চললেন, “প্রবল বিস্ফোরণে ছিটকে গিয়ে পড়েছিলাম গির্জার বাইরে। যখন জ্ঞান ফিরল তত ক্ষণে দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটিয়ে ফেলেছে জঙ্গিরা। চোখ খুলে দেখি চার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রক্ত মাখা অগুনতি নিথর দেহ।” |