অস্কারের লড়াই
গৌতম ঘোষ
এ বার অস্কারের জন্য ভারত থেকে মনোনীত ছবি নিয়ে বিতর্কের ব্যাপারে শুনেছি। ষোলো জন মেম্বারের একটা জুরি বোর্ড গঠিত হয়েছিল। আমি তার চেয়ারম্যান। হায়দরাবাদে বসে আমরা ছবিগুলো দেখি। বাইশটা এন্ট্রি ছিল। আর সবাই একমত হয়ে ঠিক করি জ্ঞান কোরিয়া পরিচালিত ‘দ্য গুড রোড’ নামক গুজরাতি ছবিটিকে ভারত থেকে মনোনীত করা হবে।
আমার মনে হয় মনোনয়নের আগে আর এক প্রস্ত মনোনয়নের প্রক্রিয়া থাকলে ভাল হয়। ছ’দিনে জুরিদের বাইশটা ছবি দেখতে হয়েছে। সেটা বেশ কষ্টকর। তা ছাড়া একটা বড় খামতি এই যে, আমরা শুধু একটা মাত্র ছবি পাঠাতে পারি। আমার তো মনে হয় ফেডারেশন থেকে অকাদেমিতে অনুরোধ করা উচিত যাতে ভারত থেকে অন্তত পাঁচটা ছবি পাঠানো যায়। এই বারই যেমন ধরুন ‘ভাগ মিলখা ভাগ’, ‘ম্যাড্রাস কাফে’, ‘বিশ্বরূপম’ এই তিনটে ছবি বেশ ওয়েলমেড বলে মনে হয়েছে আমার। ছোট স্কেলে বানানো ভাল ছবির মধ্যে পড়বে ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ আর ‘দ্য গুড রোড।’ ‘সেলুলয়েড’ বলে একটা মালয়ালি ছবি ছিল। আমার তো ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ ছবিটাও বেশ ভাল লেগেছিল। একটা মেয়ের আত্মসম্ভ্রম নিয়ে এ ছবির গল্প। আমি জুরি মেম্বারদের বলেছিলাম, সব ছবি দেখার পর তাঁরা যেন লিখিত ভাবে শর্ট লিস্ট করেন। তার পর ট্যাবুলেট করে দেখলাম যে সাত থেকে আটটা ছবি জুরি মেম্বারদের পছন্দ হয়েছে। তার মধ্যে ছিল, ‘ভাগ মিলখা ভাগ’, ‘দ্য গুড রোড’, ‘দ্য লাঞ্চ বক্স’, ‘ইংলিশ ভিংলিশ’, ‘সেলুলয়েড’, ‘শব্দ’ আর ‘বিশ্বরূপম’। আমি তার পর একটা খোলামেলা আলোচনায় বসলাম। সেখানে প্রত্যেকটা ছবি নিয়ে সব জুরি মেম্বারকেই আলোচনা করতে বলেছিলাম।
‘বেস্ট ফাইভ’ বা ‘বেস্ট থ্রি’ বলে কিছু ছবি নির্বাচন করা হয়নি। ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ ছবিটা আমারও ভাল লেগেছিল। কিন্তু দেখলাম ‘দ্য গুড রোড’ শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে গেল। গুজরাতের কছ এলাকার ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’য়ের গল্প এই ছবিতে। ছবিটা জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। আমি জানি এ দেশে কোনটা জাতীয় ও কোনটা আঞ্চলিক ছবি তা নিয়ে একটা অদ্ভুত মাইন্ডসেট কাজ করে। আমাদের সংবিধানে বলা আছে যে সব ভাষাই সমান। হিন্দি একটা লিঙ্ক ল্যাঙ্গোয়েজ। তবু হিন্দি ছবি হলে সেটাকে অনেকেই জাতীয় ছবি মনে করেন। আর আঞ্চলিক সিনেমাকে তাঁরা একটু পিছিয়ে রাখেন।
‘শব্দ’ নিয়ে কয়েক জন জুরি মেম্বার খানিকটা আলোচনা করেছিলেন। ‘শিপ অব থেসিয়াস’ নিয়েও তাই। তার পর অন্যান্য ছবি নিয়ে কথা হয়।
কেউ কেউ নরেন্দ্র মোদির ট্যুইট দেখে জিজ্ঞেস করেছেন যে মনোনয়নের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক চাপ ছিল কি না। আমার উত্তর হল, না। কোনও দিক থেকে কোনও চাপ ছিল না।
‘দ্য লাঞ্চবক্স’ আমার বেশ পছন্দ। ফিল্মটা নিয়েও বেশ একটা বাজার তৈরি হয়েছিল প্রচার মাধ্যমে। তবে জুরি মেম্বারদের কেউ কেউ বলেছিলেন ডাব্বাওয়ালাদের যে ভুলটার কথা ছবিতে বলা হয়েছে তেমন ভুল মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালারা করেন না। এটা মনে রাখতে ষোলো জন যেখানে জুরি মেম্বার সেখানে বিভিন্ন মত থাকবেই। আমি অনুরাগের বক্তব্যগুলো পড়েছি। ওর এত ঔদ্ধত্য ভাল নয়।
আমাদের জুরির গাইড লাইনে তো এটা বলে দেওয়া হয়নি যে ফিল্মের ডিস্ট্রিবিউটার কে আগে দ্যাখো। তাঁর আমেরিকাতে ছবির বিপণন করার দম আছে কি না দ্যাখো। আর বিদেশে ফোরকাস্টের কথা ধরতে গেলে তো এটাও জানতে হবে যে কার কথাকে আমরা প্রাধান্য দেব! আমার ‘মনের মানুষ’ নির্বাচিত হয়নি। যে কোনও রেসে শেষ পর্যন্ত অনেক কিছু পালটে যেতে পারে। সেরা অস্কার ছবি মানে ইউরোপ, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরানের ভাল সিনেমার সঙ্গে আমাদের সিনেমাকে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। আমরা আজকাল ভাল ছবি বানাচ্ছি। তবে সেরা বিদেশি ছবি বিভাগে পাঠানো আমাদের ছবিটিকে কান, বার্লিন, ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের মূল বিভাগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু ক্রিটিকস উইক বা অডিয়েন্স চয়েজ অ্যাওয়ার্ড পাওয়া ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতাটা নয়। জানি মিডিয়াতে ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ নিয়ে অনেক হাইপ ছিল। তবে তা দেখে আগে থেকে ধরে নেওয়া উচিত নয় যে এটাই হতে চলেছে!

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়
নিশ্চয়ই একটা ভাল ছবিই ওঁরা পাঠাবেন। ‘শব্দ’ নাকি সেরা তিনের মধ্যে ছিল। সেটাই পাওনা। যে ছবি যাচ্ছে নিশ্চয়ই জুরির সেটাই বেশি ভাল মনে হয়েছে। অনুরাগ কশ্যপ এই সিলেকশন নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন শুনেছি। ওই সব ভাবলে সারা বছর রেগেই থাকতে হবে। আমার ছবির থেকে বেটার ছবি হয়নি সেটা ভাবতে পারব না। অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো সব ভাল ছবির খবর রাখা হয় না।

নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি
আমি ‘দ্য গুড রোড’ ছবিটি দেখিনি। তবে রীতেশ বটরা পরিচালিত ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ বেশ ভাল প্রতিযোগী ছিল অস্কার দৌড়ে। কিন্তু আমি বুঝে পাই না, আমরা ভারতীয়রা কেন বিদেশি স্বীকৃতির জন্য এত মাথা ঠুকে মরি। ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ একটা ভাল ছবি, আমার কাছে সেটাই যথেষ্ট।
রসুল পুকুট্টি
আমি ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ দেখিনি। নিজে ‘দ্য গুড রোড’য়ের সাউন্ড ডিজাইন করেছি। ছবিটা ভাল। ভাল লাগা বা মন্দ লাগা তো থাকবেই। ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ নিয়ে এত কথা হচ্ছে, তবে কত জন বলছে ‘কিস্সা’ বলে একটা ছবির কথা, যেটা কিনা টোরেন্টোতে নেটপ্যাক পুরস্কার পেয়েছে। আসল কথা হল অস্কার বিতর্কটা ছবি নিয়ে নয়, সেনসিবিলিটির পার্থক্য নিয়ে। আমি ‘স্লামডগ মিলিয়ানেয়র’য়ের জন্য অস্কার পেয়েছি। নিজেও এই একই ফেজের মধ্য দিয়ে গিয়েছি যখন ‘ব্ল্যাক’ অস্কারের জন্য মনোনীত হয়নি। টিম অনুরাগের হতাশাটা আমি বুঝতে পারি। তবে ওঁরা এখনও মেন ক্যাটেগরির অস্কারের জন্য আবেদন করতে পারেন। তার জন্য আমেরিকাতে ছবিটি মুক্তি পেতে হবে।

রীতেশ বটরা
আঙুরফল টক-এর মতো শোনাতে চাই না। তবে এটা ঠিক যে আমার ‘দ্য লাঞ্চবক্স’য়ের প্রচুর সম্ভাবনা ছিল। কান, টোরেন্টো, টেলুরয়েড সব জায়গাতেই ছবিটি সমাদৃত হয়েছে। টেলুরয়েডে তো সাতটা স্ক্রিনিং হয়েছে ছবিটির। ভ্যারাইটি পত্রিকাতে লেখা হয়েছে ছবিটি নিয়ে। এমনকী বিদেশে যাঁরা বহু বছর ধরে অস্কার প্রেডিকশন করে আসছেন তাঁরাও ছবিটিকে তাঁদের তালিকায় রেখেছিলেন। এ কথা ঠিক যে অনেকেই বলেন অস্কারের কী দরকার। কিন্তু আমি বলব যে আমরা যদি অস্কার জিতে ভারতের দিকে স্পট লাইটটা আনতে পারি, তাতে ক্ষতি কী? তবে যদি ছবিটি ফাইনাল ফাইভে না থাকে, তা হলে ফিল্ম ফেডারেশনের তরফ থেকে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।

অভিজ্ঞান ঝা
গৌতম ঘোষের ছবির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। ‘শিপ অব থিসিয়াস’ বা ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ ছবির থেকে অনেক বেশি জোরালো ছবি ওঁর ‘অন্তর্জলি যাত্রা’ ছবিটা। অনুরাগ কাশ্যপ আমাকে টুইটারে যাচ্ছেতাই রকম আক্রমণ করেছে। জানি না কেন এত রোষ। অস্কার দৌড়ের কথা যখন এতই হচ্ছে হঠাৎ মনে হল, কোথায় গেল ‘শিপ অব থেসিয়াস’? মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই না বলা হচ্ছিল এটা বিশ্বের অন্যতম সেরা ছবি! তার কী হল? এই ধরনের ‘হাইপ মেশিনারি’ যাঁরা তৈরি করে তাঁদের নানা ভাবে অর্থপুষ্ট করতে হয়। এ ক্ষেত্রে বোধহয় তার অভাব দেখা গিয়েছে। অন্য দিকে ‘দ্য লাঞ্চবক্স’-এর ক্ষেত্রে পিআর-এর জন্য এখনও টাকা ঢালার যজ্ঞটা শেষ হয়নি।
মনে আছে, এক নামজাদা বাঙালি পরিচালক আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে যদি আমার ‘স্যাকরেড ইভিল’ ছবিটা লোকার্নো-তে পাঠাতে হয় তবে তাঁকে তোষামোদ করতেই হবে। আমি করিনি এবং আমার ছবিকে টেকনিকাল গ্রাউন্ডে আটকে দেওয়া হয়। বর্তমানে একগুচ্ছ লোক ‘গ্যাং অব কানস’ সেজে বসে আছে। তাঁদের কাজ হল নিজেদের ক্যাম্পে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের কাজকে মহান প্রমাণ করা। আমাদের বাণিজ্যিক ছবিগুলি পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়। তবে আর্ট ফিল্মগুলো হল আরও জঘন্য।

অনুরাগ কাশ্যপ



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.