|
|
|
|
|
|
চেনা গল্প অচেনা মোচড় |
আজ কপাল পুড়ল: চার অধ্যায়-এর
|
শান্তনু চক্রবর্তী |
|
অধ্যায় এক: বটুর কথা |
সিআরপিএফ-এর অফিসার অতীনের লাশটাকে পা দিয়ে একটু ঠেলে দিল। ঢালু জমিতে হলদেটে ঘাস আর মরা পাতার ওপর দিয়ে খানিকটা গড়িয়ে গেল কমরেড অতীন্দ্র, অতীন, অন্তু। অন্তু! সবার আড়ালে এই নামেই ডাকত না এলা অতীন্দ্রকে? প্রথম যে দিন বটু নিজের কানে ডাকটা শুনেছিল, সহ্য করতে পারেনি। কাল রাতে ঝিংড়া ইস্কুলবাড়ির ক্যাম্পে অতীনকে উপুড় করে শুইয়ে ওর পিঠের ওপর ইস্কুলের একটা বেঞ্চি চাপিয়ে যৌথ বাহিনীর কয়েক জন জওয়ান যখন দোল-দোল-দুলুনি খেলছিল, তখন পাশের ঘরে রাজ্য পুলিশের হোমরাচোমরাটি বটুর কাছে জানতে চাইছিলেন, এই লোকই কমরেড অতীন্দ্র তো? আরে, জওয়ানরা যার পিঠ-কোমর-থাই-পাছা থেঁতলে দলাই-মলাই করছে, তার মুখ দিয়ে একটাও আওয়াজ বেরোচ্ছে না, সে লোক আর কে হবে! অতীনের রোগাটে, পাকানো শরীরটা যেন পাথরের তৈরি। আর এলা, এলি? ও শরীর তো জ্যোৎস্না দিয়ে, গোলাপের গন্ধ দিয়ে, বটুর মতো কত পুরুষের গোপন দীর্ঘশ্বাস দিয়ে গড়া। এলা তো জানত, শুধু বটুই তাকে পুলিশের থার্ড-ডিগ্রি অত্যাচার থেকে বাঁচাতে পারে। বটু বলেওছিল সেটা এলাকে। এলার দু’চোখে কী যে ঘেন্না ছিল সে দিন। বটু তবু এলাকে বাঁচাতে চেয়েছে। পুলিশ কাস্টডিতে পূর্ণিমা মাহাতো, শ্রেয়সী মিত্রদের যে হাল করা হয়েছিল, এলাকে সেই অবস্থায় দেখলে সহ্য করতে পারত না ও। কাল রাত্তিরে সেই বটুই জঙ্গলে অন্তুদের গোপন ডেরার মেঝে থেকে চুলের মুঠি ধরে তুলে দাঁড় করিয়েছে এলাকে। ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরেছে। হাতটা পিছনে মুচড়ে ধরে ধাক্কা দিতে দিতে বাইরে বের করে নিয়ে গিয়েছে। |
অধ্যায় দুই: অতীনের কথা |
বটু যে এক দিন পুলিশ নিয়ে তাদের ধরতে আসবে, সেটা অতীন জানত, এলা জানত, এমনকী পার্টির স্টেট সেক্রেটারি ইন্দ্রনাথদাও জানতেন। ইন্দ্রনাথদাই এলাকে পার্টিতে এনেছিলেন, অতীনকেও। কিন্তু পার্টি ঠিক কোন পথে যাচ্ছে, তাই নিয়ে অন্তু নিজেই ভীষণ কনফিউজ্ড ছিল। পশ্চিমবাংলার শাসক-বামেরা জঙ্গলমহলের গরিব আদিবাসী মানুষের ওপর যে দাদাগিরি চালাচ্ছে, সেটা তো প্রতিরোধ করতেই হবে! কিন্তু তাদের পার্টিও তো গরিবের বিরুদ্ধে গরিবকেই লড়িয়ে দিচ্ছে। পুলিশের খোচর, শাসক পার্টির দালাল বলে অতীনরা যাদের ঘাড় থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে দিচ্ছে, তারাও তো একই রকম হদ্দ গরিব। তাদের ঘরেও তো রোগা-ডিগডিগে ন্যাংটো বাচ্চা, না-খেতে-পাওয়া ক্ষয়াটে বউ। এরা তাদের শত্রুপক্ষ? এদের খুন না করলে বিপ্লবের দেরি হয়ে যাবে? অতীন বুঝতে পারে না। তা ছাড়া শাসক বামেদের ক্ষমতা থেকে হটানোটাকেই পার্টি যে ভাবে পাখির চোখ করেছিল, বিরোধী দলের সঙ্গে গা-ঘষাঘষিটা রোজই বাড়াচ্ছিল, অতীনের মনে হয়েছিল, এক বার ক্ষমতার পাশা পালটালে পার্টির পক্ষে ওটা বুমেরাং হবে। |
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী। |
নতুন সরকারের জেলখানায় বসে ইন্দ্রদাও কি এখন ওই লাইনেই ভাবছেন? তখন কিন্তু বটুকেই বিরোধী দলের সঙ্গে লিয়াজঁ রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অতীন জানত বটু তাকে ঘেন্না করে। কারণটাও জানত। এলাও সহ্য করতে পারত না বটুকে। বটু ওর ঘিনঘিনে চোখে এলার শরীরটা যে ভাবে চেটে নিত, এলার মাথায় আগুন ধরে যেত। বরং অতীনই ওকে বুঝিয়েছিল, ‘পাত্তা দাও কেন? ইগনোর করো।’ অতীন জানত, তাদের বিপ্লবী পার্টিতেও মেয়েরা একটা আলাদা শ্রেণি, যাদের ‘শৃঙ্খল’ কোনও দিনই হারাবার নয়। ইন্দ্রনাথদা অতীনকে পার্টিতে এনেছিলেন, আবার অতীনকে পার্টিতে ধরে রাখতেই এলাকে ব্যবহার করেছিলেন। আর এলা যে কী অলৌকিক চুম্বকে টেনেছিল অন্তুকে! |
অধ্যায় তিন: এলার কথা |
এলা জানত, সে ডাকলে যত রাতই হোক অন্তু আসবেই। একা। কাঁধে তার চিরসঙ্গী এ. কে. ফর্টিসেভেন। কাল রাত্তিরে অন্তু হাইড আউটে ঢোকা মাত্রই এলা ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়েছিল। প্রেমের এই গেরিলা-হানায় অন্তুর সংযমের সব ডিফেন্স চুরমার হয়ে গিয়েছিল। যৌথ বাহিনীর লোকজন নিয়ে বটু যখন ঘরে ঢুকেছে, তখন অন্তু মাটিতে শুয়ে। ওর বুকের ওপর এলা। ওর গহন-কোমল খোলা চুলে ঢাকা অন্তুর মুখ। বন্দুকটা একটু দূরে কাত করে রাখা। মেঝেতে বুটের দাপাদাপির শব্দে এলা সরে এসেছিল। ওকে চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করিয়েছিল বটু। অন্তু গড়িয়ে বন্দুকটা অবধি পৌঁছনোর আগেই বাহিনীর লোকেরা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তার পর কী হয়েছে এলা দেখেনি। বটু ওকে বের করে নিয়ে এসেছিল। রাতেই ওকে সদর হেড কোয়াটার্সে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে রকমই কথা ছিল। কাল রাতে আদরের সময় অন্তু ওই কবিতাটা আবার বলেছিল
প্রহরশেষের আলোয় রাঙা
সেদিন চৈত্র মাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম
আমার সর্বনাশ।
কী নরম শোনাচ্ছিল গলাটা। কিন্তু এলা কী করতে পারত! রাজ্যে সরকার বদলে যাওয়ার পর সংগঠন যখন ছন্নছাড়া, ইন্দ্রদা ধরা পড়ে গেছেন, এলা তখন অনেক বার বলেছে চলো সারেন্ডার করি। রাতদিন এমন জন্তুর মতো পালিয়ে-পালিয়ে আর বাঁচা যায় না। বটু বলেছে, সরকার ভাল প্যাকেজ দিচ্ছে। পুরনো কেস সব তুলে নেবে। নতুন একটা জীবন শুরু করার সুযোগ। কিন্তু অন্তু শুনলে তো! নিজেকে শেষ করে দেওয়ার বিপ্লবী রোমাঞ্চ ওর ঘাড় থেকে নামলই না। উলটো দিকে বটু অনেক প্র্যাক্টিকাল। ওকে দেখে গাঁট মনে হয়, আসলে লোকটার ভাবনাচিন্তাগুলো বেশ পরিষ্কার। বটু বলেছিল, সরকার অন্তুকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় না। কিন্তু এলাকে সে এখনও উদ্ধার করতে পারে। এলা বটুর বাড়ানো হাত ধরেছিল। অন্যায় করেছিল? জঙ্গলে, বুনো ঘাসের বিছানায়, অন্তুর পাশে শুয়ে শহিদের মৃত্যু ও-সব সিনেমায় হয়। জীবন অন্য রকম। অন্তু জানলই না। |
অধ্যায় চার: দেশের কথা |
পরের দিন খুব ভোরে জঙ্গলে যৌথ বাহিনীর অনেকগুলো বুলেটের একটা কমরেড অতীনের ডান চোখ ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। অন্তু কি তখনও এলাকে দেখতে চাইছিল? মাস তিনেক পরে এলা আর বটু একসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে আত্মসমর্পণ করে। মিডিয়াকে এলা জানিয়েছে, এই তিন মাস সে বটুর গ্রামের বাড়িতে ছিল। ওটাই তো এখন তার শ্বশুরঘর। কমরেড অতীন্দ্রর এনকাউন্টারের ব্যাপারে তার কিছু জানা নেই। এলা আরও বলেছে, এ বার পঞ্চায়েতে সে শাসকদলের হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বটুও। |
|
|
|
|
|