গুরুনাথ মইয়াপ্পনকে তাঁর শ্বশুরমশাইয়ের ঘনিষ্ঠ কিছু বোর্ড সদস্যও মনে হয় না কোনও দিন ক্ষমা করবেন বলে! গুরুনাথের উৎপাতেই তো তাঁদের লোভনীয় মামাল্লাপুরম দর্শন, রিসর্টে তিন দিন নিখরচায় থাকা আর শেষ সেপ্টেম্বরের ছুটির দিনগুলো বানচাল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে!
শনিবার মুম্বই পুলিশের চাঞ্চল্যকর চার্জশিট পেশের পর যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে তা অভাবনীয়, ঐতিহাসিক এবং একই সঙ্গে কলঙ্কিতও। এর ফলে শুধু আইপিএল ঘিরে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের গন্ধই আবার নতুন করে উঠে আসেনি। দেশের প্রকৃত ক্রিকেট নিয়ামক কে এবং কারা, সেটা নিয়েই সংশয়ের একটা চোরাস্রোত তৈরি হয়েছে। টেকনিক্যালি কে তা হলে দেশের শীর্ষ ক্রিকেট কর্তা? কে ঠিক করবেন সচিনের দুশোতম টেস্ট কোথায় হবে?
শ্রীনিবাসন? তিনি তো লিখিত হলফনামা জমা দিয়েছেন, মইয়াপ্পন-তদন্ত শেষ না হওয়া অবধি বোর্ডের দৈনন্দিন কাজে অংশগ্রহণ করবেন না।
অন্তর্বর্তিকালীন প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া? তাঁর অন্তর্বর্তিকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়নকে তো এ দিন দিল্লির পাটিয়ালা হাউসের অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট কার্যত বেআইনি বলে দিয়েছে।
বোর্ড সচিব সঞ্জয় পটেল? তাঁর মনোনয়ন তো আরও অবৈধ। ডালমিয়ারটা তো তবু ওয়ার্কিং কমিটি করেছিল। সঞ্জয় পটেলেরটা এক বিকেলে হঠাৎ সিএবি ক্লাবহাউসে ডালমিয়া ঘোষণা করে দিয়েছেন। আইনের চোখে তিনি যদি বোর্ড সচিব হন, তা হলে গতকাল প্রয়াত জয়বন্ত লেলে-ও বোর্ডের সচিব!
রাত্তিরে জনাকয়েক বোর্ড সদস্য প্রশ্ন তুললেন, সঞ্জয় পটেলের এসজিএম ডাকার সিদ্ধান্ত যেখানে বেআইনি ঘোষণা করেছে আদালত, সেখানে তাঁর বার্ষিক সাধারণ সভা ডাকার নোটিসটাও তো অবৈধ। প্রশ্ন হল, তা হলে বোর্ডের বার্ষিক সাধারণ সভা ২৯ সেপ্টেম্বর হবে কী করে?
গত ক’দিন ধরেই কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল যে, শশাঙ্ক মনোহর-পক্ষের আইনজীবী হরিশ সালভে এবং ললিত মোদীর মধ্যে লন্ডনে বৈঠক চলছিল। অনেকেই ভেবেছিলেন সেটা একান্তই শ্রীনি-কেন্দ্রিক। শনিবার রাতের পর অনেকে নিশ্চিত হয়ে পড়ছেন, অতর্কিতে দিল্লির পাটিয়ালা হাউসের অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট থেকে মোদীর অর্ডার বের করে আনাটার পিছনে নিশ্চয়ই সালভের মস্তিষ্ক।
জয়পুরে সচিন বনাম রাহুল ম্যাচও এর অর্ধেক রোমাঞ্চকর হয়নি, বেলা তিনটের পর থেকে শ্রীনিবাসন বনাম শশাঙ্ক মনোহর ঘিরে যা ঘটল। অন্ধ্রপ্রদেশের গঙ্গা রাজুকে নিজের দিকে টেনে এনে পরশু আচমকা প্রথম রাউন্ড ছিনিয়ে নিয়েছিলেন শ্রীনি। শনিবার দ্বিতীয় রাউন্ডে তিনি শুধু বিরাট ব্যবধানে হারেননি, পুরো ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনের ভিতটাই নড়ে গিয়ে আতঙ্কিত চেহারায় দেখা দিয়েছে।
সবচেয়ে অস্বস্তির মুখে পড়েছেন অরুণ জেটলি। কৌরব বনাম পাণ্ডব যুযুধান দুই পক্ষে তিনি হলেন কৃষ্ণ। ধরে নেওয়া হয় জেটলি যে দিকে, জয় সে দিকে। তা তিনি হঠাৎ চলতি সপ্তাহে শরদ পওয়ারের বাড়িতে ডিনার করে শ্রীনির দিকে ভোটযুদ্ধে ঢলে পড়লেন। মনোহররা ভাবতেই পারেননি, শেষ দৃশ্যে জেটলি তাঁদের এ ভাবে পরিত্যাগ করবেন! জেটলি আবার শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির প্রধানও। যিনি মাত্র দু’দিন আগে ঘটা করে শ্রীসন্ত-সহ রাজস্থান রয়্যালস টিমকে কড়া শাস্তি দিয়েছেন। শনিবার মুম্বই পুলিশের চার্জশিট পেশের পরে প্রশ্ন উঠে গেল, জেটলি এ বার চেন্নাই সুপার কিংস নিয়ে কী করবেন? রাজস্থানের অমিত সিংহকে যদি খবর পাচারের জন্য পাঁচ বছর সাসপেন্ড করা হয়, তা হলে গুরুনাথ তো আরও অনেক বড় দোষে দোষী।
শ্রীনিরা কাল পর্যন্ত ভেবেছিলেন, গুরুনাথের বিরুদ্ধে বেটিংয়ের অভিযোগ থাকবে। যা ভারতে আইনসম্মত না হলেও অপরাধের বিচারে হালকা। কার্যত দেখা গেল মুম্বই পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ এনেছে। আইনের চোখে এ হল সেশন বেটিং। ব্যবসা জগতে যাকে বলা হয় ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’। মার্কিন আদালতে যে অভিযোগে রজত গুপ্তের জেল হয়েছিল। অর্থাৎ, তুমি নিজের পদাধিকার বলে কোম্পানির ভিতরের খবর জানছ আবার সেটাই বাণিজ্যিক মূল্যের বিনিময়ে বাজারে বেচে দিচ্ছ। অভিযোগ, শ্রীনি-র জামাইও একই রকম কাজ করেছেন। কী ভাবে বলিউড অভিনেতা বিন্দু দারা সিংহ মারফত গুরুনাথ বেটিংটা চালাতেন, তা চার্জশিটে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে একাধিক উদাহরণও দেওয়া হয়েছে। যেমন কী ভাবে একাধিক ম্যাচের আগেই গুরুনাথ অক্লেশে বিন্দুকে ফলাফল বলে দিয়েছেন। ব্যাটিং অর্ডার এবং কী ভাবে দল গঠন হবে, সবই প্রকাশ্যে ফাঁস করে দিয়েছেন গুরুনাথ। এমনকী দলের হারার পক্ষেও যে বাজি ধরেছেন, সেটা তাঁর সঙ্গে বিন্দু দারা সিংহের কথোপকথনে ধরা পড়েছে। প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, তা হলে কি তিনি টিমের অভ্যন্তরে ফিক্সিংয়ের আয়োজন করেছিলেন? নইলে টিমের হারার পক্ষে বাজি ধরবেন কেন? শ্রীনিবাসনের নিজের দল চেন্নাই সুপার কিংস আইপিএলের ছ’বছরে এত কেলেঙ্কারির মধ্যেও কখনও এ রকম পরিস্থিতিতে আসেনি যেখানে আইনের চোখে পরিষ্কার, রক্ষকই ভক্ষক!
রাত্তিরে শোনা গেল বোর্ড কর্তারা খুব ঘাবড়ে গিয়েছেন। এত জোরালো চার্জশিট তাঁরা আশঙ্কাই করেননি। একই দিনে যে দিল্লি অ্যাডিশনাল কোর্ট থেকে জোড়া ধাক্কা আসবে, এটাও ভাবনার অতীত ছিল। সোমবার দ্রুত তাঁরা দিল্লি হাইকোর্টে গিয়ে এই অর্ডার তোলার চেষ্টা করবেন। যা শুনে বিরোধী পক্ষের এক মাথা বললেন, “ওরা কি ভাবছে আমরা বোকা? আমাদের ক্যাভিয়েট করা রয়েছে।” এর অর্থ, বিচারপতি এক পক্ষের বক্তব্য শুনে কোনও রায় দিতে পারবেন না। আর সোমবার কোর্ট খোলার আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে শুনানিও করা যাবে না। অর্থাৎ ললিত মোদী নিয়ে বৈঠক ২৫ সেপ্টেম্বর করার দৃশ্যত কোনও উপায় নেই।
বিরোধীপক্ষের আইনজীবী হরিশ সালভের দেশে ফেরার কথা ছিল বুধবার। আদালতে মরণকামড় দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি সফর কাটছাঁট করে ফিরে আসছেন সোমবার। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে তাঁর এবং নলিনী চিদম্বরমের জোড়া আক্রমণের সামনে পড়তে পারে শাসকগোষ্ঠী। আদিত্য বর্মার তরফে সে দিন আইনজীবীরা আবেদন জানাবেন, শ্রীনিকে যাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বিরত রাখা হয়। নিজের জামাই যেখানে এমন কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে, সেখানে তিনি বোর্ড প্রধান থাকলে তদন্তের কাজ শুধু ব্যাহত হবে না, অনেক প্রমাণ লোপাট হয়ে যেতে পারে।
শনিবার জনাকয়েক বোর্ড সদস্য বলছিলেন, আইনি চাপে প্রশাসনের এমন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়া বোর্ডের ইতিহাসে ঘটেনি। এখন তো বোঝাই যাচ্ছে না, কে আইনসিদ্ধ আর কে নয়। পুরো ব্যাপারটাই ঘটছে কোর্টরুমে। আর এক জন বললেন, “গুরুনাথ আর শ্রীনিকে বাঁচাতে গিয়ে কোর্টে যা টাকা খরচ হচ্ছে তাতে একটা আন্ডার নাইন্টিন টিম বিদেশে ঘুরে আসতে পারত!” শ্রীনি এ দিন বলেছেন যে, আইন নিজের পথে চলবে। আর অনেক বার বলেছেন, গুরুনাথের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। প্রথম দিন বলেছিলেন, “ওর কোনও দোষ নেই। গুরুনাথ নিছক ক্রিকেট উৎসাহী।” এ সব দেখেশুনে তাঁর ঘনিষ্ঠরাও কেউ কেউ বলছেন, অন্তত আগেপিছে স্যার কী বলছেন, সেটা ওঁর নিজের মনে রাখা উচিত! আবার জয়বন্ত লেলের কথা কারও কারও মনে পড়ে যাচ্ছে। যিনি আজ এই কথা বললে পরের দিন বলতেন, “আমি বলিনি।” শনিবার রাতে নাগপুরে মনোহরকে ধরার চেষ্টা করেও ধরা গেল না। তবে শোনা গেল, তিনি খোশমেজাজেই আছেন।
প্রথম রাউন্ডে হেরে তিনি সমতা ফিরিয়েছেন। ফল ১-১। আগামী সপ্তাহ শ্রীনি বনাম মনোহর ডুয়েলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। আদালত কক্ষে তৃতীয় রাউন্ড যিনি জিতবেন, মনে হচ্ছে ম্যাচ তাঁর।
|
জোড়া ধাক্কা |
জামাইয়ের নামে চার্জশিট |
গুরুনাথ মইয়াপ্পন |
• তথ্য প্রযুক্তি আইন (৬৬এ)
• জুয়া আইন(৪, ৫)
• ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৬৫ ধারা (জালিয়াতি), ৪৬৬ ধারা (আদালত বা সরকারি নথির রেকর্ড জাল করা), ৪৬৮ ধারা (প্রতারণার জন্য জালিয়াতি), ৪৭১ ধারা (জাল নথিকে আসল বলে চালানো), ৪৯০ ধারা (চুক্তিভঙ্গ), ৪২০ ধারা (প্রতারণা), ২১২ ধারা (অপরাধীকে আশ্রয় দান), ১২০বি ধারা (ষড়যন্ত্র), ৩৪ ধারা (অপরের সঙ্গে একযোগে অপরাধ করা) |
মোদীর মামলা |
ললিত মোদী |
• ললিত মোদীকে নিয়ে ২৫ তারিখ বোর্ডের বিশেষ সাধারণ সভার উপর দিল্লি কোর্টের স্থগিতাদেশ। |
|
চার্জশিটে নালিশ |
১২ মে: রাজস্থান রয়্যালস ম্যাচে নিজের দল সিএসকে-র বিরুদ্ধে বাজি ধরেন গুরুনাথ। চেন্নাই ম্যাচ হেরে যায়।
১২ মে: বিন্দুকে গুরুনাথ জানান, তাঁর দল ১৩০ থেকে ১৪০ রান তুলবে। চেন্নাই করে ১৪১।
১৩ মে: বেলা পৌনে তিনটে নাগাদ গুরুনাথকে ফোন বিন্দুর, টিমের সঙ্গে গিয়ে বসো। যাতে টিমের খবরগুলো বুকিদের পৌঁছনো যায়।
১৯ মে: ম্যাচ শুরুর আধ ঘণ্টা আগে গুরুনাথের ফোন বিন্দুকে: ‘আমরাই জিতছি।’ ম্যাচ জেতে চেন্নাই। |
|