শহরের এক ব্যস্ত মোড়ে রাস্তার দু’ধারে সার দিয়ে বসানো নানা মাপের হোর্ডিং-ব্যানার-ফেস্টুন। কোথাও আবার পড়ে রয়েছে হোর্ডিংয়ের কঙ্কালসার কাঠামো। প্লাস্টিকের আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে গিয়েছে ফুটপাথও। কোনও ক্ষেত্রেই নেই ন্যূনতম শৃঙ্খলা। কলকাতা শহরে দৃশ্যদূষণের এই সমস্যা দীর্ঘ দিনের। এ নিয়ে শহরবাসীর অভিযোগের কথা অজানা নয় প্রশাসনেরও।
শহরের সাজ বদলের দাবি তুলেছিলেন খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় হোর্ডিং-ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো, সেই সঙ্গে হকারদের ফুটপাথ ব্যবহার-সহ বিবিধ পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন তিনি।
দৃশ্যদূষণ নিয়ন্ত্রণে রূপ বদলের সেই স্বপ্ন কতটা পূরণ হল?
শ্যামবাজার মোড়: বাহারি রেলিং, রকমারি আলোর মতো নানা জিনিসের ব্যবহারে ঢেলে সাজা হয়েছিল এই পাঁচ মাথার মোড়। কিন্তু বছর না ঘুরতেই পরিস্থিতি যে কে সে-ই। আর জি কর হাসপাতালের দিকে যাওয়া রাস্তার দু’ধারের বাড়িগুলি ফের ঢাকা পড়েছে ছোট-বড় অসংখ্য হোর্ডিংয়ে। আগের অবস্থায় ফিরে গিয়েছে নীচের ফুটপাথও। ধার ঘেঁষে বাঁশের খাঁচা তৈরি করে ঝুলছে বিভিন্ন পুজো কমিটির হোর্ডিং। ফের ফুটপাথ জুড়ে বসে গিয়েছে নানা রকম খাবারের দোকানও। রাস্তার ধারে যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপ। ফুটপাথের পাশে বাহারি রেলিংয়ে রকমারি রুমাল থেকে বস্তা, ঝুলতে দেখা যায় সবই। কোথাও আবার রাস্তার ধারের বাতিস্তম্ভ ঢেকে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজনৈতিক কিংবা বিনোদন জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাট-আউট। |
শুধু শ্যামবাজার নয়, শহর জুড়ে সর্বত্র এমনই দৃশ্য।
গড়িয়াহাট মোড়: ফুটপাথ থেকে বসতবাড়ি, সবই ঢাকা পড়েছে রকমারি বিজ্ঞাপনী ব্যানার-হোর্ডিংয়ে। পুজোর আগে অবস্থা আরও বেহাল। ফুটপাথ ঘেঁষে বিভিন্ন পুজোর প্রচারে হোর্ডিং ও ব্যানার। ফুটপাথের অস্থায়ী দোকান কোথাও কোথাও রাস্তাতেই নেমে এসেছে। প্রতিদিনের আবর্জনা সেখানে বাড়তি সংযোজন।
ধর্মতলার মোড়: ব্যানার-ফেস্টুন কিংবা হোর্ডিংয়ের রমরমা কিছুটা হলেও কমেছে। তবে রূপ বদলায়নি ফুটপাথের। যতক্ষণ ফুটপাথ জুড়ে রকমারি জিনিসের অস্থায়ী দোকানগুলি থাকে, ততক্ষণ যত্রতত্র জমে থাকে আবর্জনা।
শুধু তিনটি মোড়ই নয়, খন্না, হাতিবাগান, মানিকতলা, মৌলালি, শোভাবাজার, গিরিশ পার্ক-সহ উত্তর থেকে দক্ষিণ কিংবা পূর্ব কলকাতার সর্বত্র দৃশ্যদূষণের এমনই ছবি। বি-বা-দী বাগ, চৌরঙ্গির মতো শহরের হেরিটেজ জোনে অবশ্য হোর্ডিং নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট পুরসভা। তবুও কিছু কিছু জায়গায় চোখে পড়ে নতুন হোর্ডিং অথবা খালি কাঠামো।
শ্যামবাজারবাসী নিত্যগোপাল ভৌমিক বলেন, “হোর্ডিং, ব্যানার থাকবেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখতে ভালই লাগে। কিন্তু একটু শৃঙ্খলা মেনে তো চলা যায়। জনবহুল জায়গায় সকলে মিলে হামলে পড়ছে। শহর জুড়ে সৌন্দর্যায়নের কাজ চললেও আখেরে দৃশ্যদূষণ কমেনি।”
সমস্যা ঠিক কোথায়? হোর্ডিং ব্যবসায়ীদের একাংশের মতে, স্থায়ী হোর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে পুরসভার নির্দিষ্ট মাপ রয়েছে। কিন্তু কোথায় ক’টি হোর্ডিং লাগানো যাবে, তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও নিয়মের কথা জানা নেই। অনেক ক্ষেত্রে উৎসব কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য লাগানো অস্থায়ী হোর্ডিং-ব্যানার অনুষ্ঠান শেষের পরেও থেকে যাচ্ছে।
প্রশাসন কী বলছে? |
কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার বলেন, “রাস্তায় হোর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে পুরসভার নির্দিষ্ট মাপ রয়েছে। কিন্তু বাড়ির উপরে হোর্ডিং লাগানোর ক্ষেত্রে অনেকেই পুরসভার অনুমোদন নিচ্ছেন না। আবার বিভিন্ন উৎসব কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য লাগানো অস্থায়ী হোর্ডিং-ব্যানারও দীর্ঘ দিন রাস্তাতেই থেকে যাচ্ছে। সেগুলি সরানো হচ্ছে না। কোথায়, কী মাপের কত সংখ্যক হোর্ডিং লাগানো যেতে পারে, সে নিয়ে নির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরির চেষ্টা চলছে।” তবে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক কর্মসূচি বা উৎসবের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হয়। কর্মসূচি শেষ হলেই দ্রুত সেগুলি সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাকি সময়ে অবশ্য অস্থায়ী হোর্ডিং-ব্যানার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। অনুমতিহীন হোর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবনা চলছে।’’
কিন্তু শুধু হোর্ডিং-ব্যানারই নয়, ফুটপাথগুলিকে যে ভাবে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতেও দূষণ ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ। পুর-কর্তৃপক্ষের দাবি, অসংখ্য মানুষের রুজির বিষয় জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে। তাই আর্থ-সামাজিক দিকটির কথাও ভাবতে হচ্ছে। তবে নিয়ন্ত্রণ করা হবেই। পরিকল্পনাও চলছে। |
ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী ও শুভাশিস ভট্টাচার্য |